ইসহাক ইবনু রাহওয়াইহ রাহিমাহুল্লাহ খুব চমৎকার একটা ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলের সাথে তার শেষ হজে আমি সফরসঙ্গী ছিলাম। আমরা যখন মদিনার শেষ উপকণ্ঠে এসে পৌঁছাই, তখন আমাদের সামনে এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ এসে উপস্থিত হলেন। বয়সের ভারে তার চোখের ভু-যুগল পর্যন্ত সাদা হয়ে গেছে। বয়স্ক লোকটার সাথে তরুণ ও আধ-বয়স্ক মিলিয়ে আরো অনেকগুলো মানুষ ছিলো এবং তাদের একজন আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আপনাদের মধ্যে আহমাদ ইবনু হাম্বল কে?’
তখন আমাদের দলে থাকা অন্য লোকেরা হাত উঁচিয়ে আহমাদ ইবনু হাম্বলকে দেখিয়ে দিলো। এরপর, জরাগ্রস্ত ওই বৃদ্ধ লোক, অন্য একজনের সহায়তায় কোনোমতে আহমাদ ইবনু হাম্বলের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘তোমার নাম আহমাদ ইবনু হাম্বল?’
আহমাদ ইবনু হাম্বল বললেন, ‘আমার আম্মা এমনটাই আমার নামকরণ করেছেন।’
‘বাছা, তুমি কি আমায় চিনতে পেরেছো?’
‘আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।’

বৃদ্ধ লোকটা বললেন, ‘আমি ওবাইদুল্লাহ ইবনু মুসা ইবনি জাফর ইবনি মুহাম্মা ইবনি আলি ইবনিল হুসাইন ইবনি আলি ইবনি আবি তালিবের বংশের মানুষ আমি গতকাল স্বপ্নে দেখেছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু ত রাযিয়াল্লাহু আনহু ও উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বাগদাদ অতিক্রম করছেন। এমন সময় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ডান কাঁধ থেকে তার চাদরখানা মারীতে পড়ে যায়। তারপর আমি দেখলাম, হঠাৎ কোথেকে যেন এসে তুমি নবিজি সা আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদরখানা মাটি থেকে কুড়িয়ে পুনরায় তার ডান কাঁধে চড়িয়ে দিলে। তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমার দিকে তাকালেন। সাথে আবু বকর ও উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমাও। তারা হাসিমুখে তোমাকে বললেন, ‘আহমাদ। সুসংবাদ গ্রহণ করো। জান্নাতে তুমি আমাদের সাথি হচ্ছো।’
এরপর, ওই বৃদ্ধলোক সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমরা কি জানো, ‘আহমাদ ইবনু হাম্বল নবিজির চাদর কুড়িয়ে নিয়ে নবিজির কাঁধে তুলে দিয়েছেন’। বলতে স্বপ্নে কী বোঝানো হয়েছে? উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে একজন শাইখ বললেন, এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে-নবিজির সুন্নাহকে, যা থেকে এখন মানুষ বিমুখ হয়ে আছে, দূরে সরে আছে, আহমাদ ইবনু হাম্বল তা পুনরায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে।’
ইসহাক ইবনু রাহওয়াইহ বলেন, বৃদ্ধের এই কথা শুনে বিমর্ষ হয়ে যান আহমাদ ইবনু হাম্বল। তিনি বলেন, ‘আহা! এই কথা শোনার আগে যদি আমার এবং এই লোকের মাঝে একটা পাহাড় এসে দাঁড়াতো, কতই না উত্তম হতো।’
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, জান্নাতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথি হতে পারার যে সৌভাগ্য ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহকে বৃদ্ধ লোকটা শোনালেন, তা কি ইমাম আহমাদ পছন্দ করেননি? এজন্যই কি তিনি বলেছেন, ‘এই কথা শোনার আগে আমার এবং এই লোকের মাঝে যদি একটা পাহাড় এসে দাঁড়াতো, কতই না উত্তম হতো’?
না, আসলে ব্যাপারটা তা নয়। জান্নাতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথি হওয়ার স্বপ্ন তো প্রত্যেক মুমিনের। ইমাম আহমাদ সেটা অপছন্দ করবেন, তা কী করে হতে পারে? বরং তিনি ভয় পেয়েছেন একটা জিনিসকে-আত্মম্ভরিতা। আত্মমুখতার ভয়। তিনি শঙ্কিত হয়েছেন-যদি এই বৃদ্ধ লোকের কথা শুনে তার মনে অহমিকা প্রবেশ করে? নবিজির হাদিসকে পুনরুজ্জীবিত করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে পুরস্কারের কথা এই বৃদ্ধলোক তাকে জানিয়ে গেলেন, তা থেকে যদি তার অন্তরে আত্মম্ভরিতার জন্ম নেয়? যদি কোনোভাবে তাতে রিয়া তথা লোকদেখানো অনুভূতি প্রবেশ করে, তাহলে তো সর্বনাশ! এ-কূল ও-কূল সবকূলই যে তখন হারাবেন তিনি!
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ ঠিক এই কারণেই সেদিন ভীত হয়ে ছিলেন। নিজের ভেতরে যাতে কোনো অহংকার, আত্মমুগ্ধতা না আসে, সেজন্যই তিনি দুজনের মাঝে একটা পাহাড়ের বাধা আশা করে ছিলেন।
ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহর এই ঘটনা থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। নিজের ব্যাপারে আমরা যখন অনেক বেশি আত্মতুষ্টিতে ভুগবো, তখন আখিরাতে ভালো ফলাফল লাভের আশা আমাদের জন্য ক্ষীণ হয়ে আসবে। ‘আমি তো অনেক বেশি ইবাদত করি, আমল করি, সাদাকা করি, দ্বীন প্রচার করি’-এই অতি-ভাবনাগুলো আমাদের যাবতীয় আমলকে বিনষ্ট এবং আমাদের আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবার জন্য খুবই যথেষ্ট।