ইতিহাসের কিছু দুর্বিপাকের মধ্যে একটা ভারি দুর্ভাগ্যজনক এবং মানব সভ্যতার একটা বড় বদকিসমতি হল এই, পশ্চিমা সভ্যতা এমন এক সময়ে প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করেছে, যখন ইসলামের বিরোধিতা ও বিরুদ্ধাচরণ করা তার জন্য সাধারণ বিষয় ছিল। যখন আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস, গায়েবের প্রতি ঈমান আনার বিষয়ে ইসলামের দেওয়া খবর ও নির্দেশকে অস্বীকার করা তার জন্য মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।
পশ্চিমারা এমন এক জাতির মধ্যে পয়দা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই ইসলামের ব্যাপারে অবাধ্য ছিল। যারা নিজেদেরকে ঈসায়ি ধর্মের অনুসারী দাবি করত। কিন্তু ধর্মকে তারা নফসানি খাহেশাত, গর্ব ও আত্মম্ভরিতা এবং স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম ও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। তারা নোংরা ও নষ্ট জীবানাচারে অভ্যাসী ছিল। অন্যায় ও অনাচারকে প্রশ্রয় ও পরিতোষণকারী ছিল। ভীত আতঙ্কিত নির্জনতা ও বিজনতায় অভ্যস্ত ছিল। মানুষ ও মানবতার ব্যাপারে তারা ছিল বর্বর।
তাদের মধ্যে জীবনের বিষয়ে ছিল অবসাদ ও ক্লান্তি। সহি ইলম ও সঠিক বুদ্ধি-বিবেচনা না থাকায় সুন্দর জ্ঞান ও মেধার পথে তারা ছিল বাধা ও প্রতিবন্ধক। এসব কারণে ইসলামপূর্ব পশ্চিমাজগৎ সুস্থ-সুন্দর জীবনের ব্যাপারে ছিল বিমুখ ও পলায়নমুখী।১
তার নতিজা হয়েছে এই, সভ্যতার প্রসার ও ক্রমবিকাশ ঘটেছে একদমই বস্তুবাদী ভাবনায়। শিল্পোন্নয়ন ও জাগতিক সব ক্রমোন্নতি বিস্তার লাভ করেছে বস্তুবাদী চেতনায়। জীবন-যিন্দেগির কর্ম ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিগুলো প্রসূত হয়েছে বস্তুবাদী প্রেরণায়। ফলে পশ্চিমাদের হাতে সৃষ্ট জিনিসগুলো মানুষকে বিশ্বজগতের স্রষ্টার আনুগত্য থেকে গাফেল করে দিয়ে বস্তুর মধ্যে লিপ্ত করতে লাগল। তাদের আবিষ্কার ও উদ্ভাবন মানুষকে মহান আল্লাহ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে বস্তুর মধ্যে ডুবাতে লাগল।

পশ্চিমারা তাদের নষ্ট চিন্তা-চেতনা দিয়ে পুরো সমাজ ও সামাজিকতা এবং সমগ্র মানুষ ও মানবতার সুন্দর নিয়ম ও শৃঙ্খলকে তছনছ করে দিতে লাগল। এ ধ্বস ও অধঃপতন ঘটেছে বস্তুবাদী দর্শনের ফলে। যা বিশেষভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর জীবনাচারের সবটা দখল করে রেখেছে। ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করেই পশ্চিমা সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। ফলে তারা মানবতার সব সৌন্দর্য হারানোর পাশাপাশি চারিত্রিকভাবেও চরম অধঃপতনে নিপতিত হয়েছে।
অপর দিকে নতুন নতুন উপায়-উপকরণ তৈরি করা, উদ্ভাবিত জিনিসকে বশ ও ব্যবহারের উপযোগী করা, বিজ্ঞানের আবিষ্কার, উন্নতি ও উৎকর্ষতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও পশ্চিমারা অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তাদের কাছে এখন দূর ও দূরত্ব শেষ হয়ে গেছে। তাদের আবিষ্কার এখন বাতাসের গতিকে অতিক্রম করে গেছে। চাঁদের দেশেও তারা কদম রেখেছে। এছাড়াও পশ্চিমারা জল-স্থল ও গ্রহ-নক্ষত্রের বিষয়েও অনেক উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জন করেছে।
ফলাফল হল এই, বস্তু ও উপকরণের সীমাহীন উন্নতি এবং বস্তুশক্তি মানুষের স্বভাবগত শক্তি ও সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছে। সেইসঙ্গে পৃথিবীতে কুফর ও নাস্তিকতা ছড়িয়ে দিয়েছে। ভোগ-বিলাসিতায় মানুষকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করে রেখেছে। এগুলো বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য। আমাদের কাছে এমন কোনো সভ্যতা ও জাতি-গোষ্ঠীর কথা জানা নেই, যারা এ পরিমাণ জাগতিক উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জন করার সাথে সাথে ঈমান ও ইসলামের এতটা বিরোধী হয়েছে। বিশ্বজগতের স্রষ্টা এবং তাঁর নির্দেশিত দীন ও শরিয়তের এমন অবাধ্য হয়েছে। এতটা নফসের গোলাম ও খাহেশাতপূজারি হয়েছে।
ঈমান ও ইসলামকে ভুলে, আখেরাত ও পরকালকে অস্বীকার করে দুনিয়ার মধ্যে লিপ্ত হয়েছে। এ রকম আর কোনো জাতি ছিল কি না আমাদের জানা নেই। যতটা হয়ে আছে ইউরোপ আমেরিকা-পশ্চিমা সভ্যতা।
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.