চেঙ্গিস খান-একটি প্রলয়ঙ্করী তুফানের নাম। গোবির বুক চিরে লাফিয়ে ওঠা প্রচন্ডগতির বিশ্ববিধ্বংসী এক মরু সাইমুম।
খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর ষষ্ঠ দশক। বর্তমান মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরের ২০০ মাইল উত্তর-পূর্বে ওনোন নদীর তীরে বোরজিগিন বংশে জন্ম নেয় নিরীহ এক শিশু-তেমুজিন। কালক্রমে সে-ই হয়ে ওঠে ভয়ংকর বিশ্বত্রাস-চেঙ্গিস খান। মাত্র নয় বছর বয়সেই নিহত হয় তার পিতা। পরিবার হয় বাস্তুচ্যুত, গোত্রছাড়া। অপহৃত হয় তার বাগদত্তা। পালিয়েই কাটে তার শৈশব, কৈশোরকাল। মানবেতিহাসের সর্বকালের সর্বাধিক নিষ্ঠুর এই যোদ্ধা তাই প্রাথমিক জীবনে ছিলেন নিতান্তই নিগৃহীত, বঞ্চিত। হয়তো এরই রূঢ় প্রভাব প্রতিবিম্বিত হয় তার পরবর্তী জীবনে। ৪ কোটি বনি আদমের হত্যার দায়ে বিশ্ব-ইতিহাসের আবহমান কাল ধরে তিনি যদিও খলনায়করূপে পরিচিত, তথাপি আধুনিক মঙ্গোলিয়ায় তিনি একজন সম্মানিত বিশিষ্টজন ও বরেণ্য ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচিত। মোঙ্গল জাতির জনক হিসেবে সেখানে তিনি আজও বরিত, সমাদৃত। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের মহামতি খাকান হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে নিজের অসামান্য নেতৃত্বগুণে পূর্ব ও মধ্য-এশিয়ার অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন যাযাবর জাতিগোষ্ঠীকে তিনি একই সূত্রে গ্রথিত করেন। একটিমাত্র সামাজিক পরিচয়ের অধীনে নিয়ে আসেন বহুধাবিভক্ত মানবসম্প্রদায়কে। সুসংঘবদ্ধ এই জাতিসত্তাই পরবর্তী ইতিহাসে অভিহিত হয় মোঙ্গল নামে, যার রূপকার ছিলেন চেঙ্গিস খান খ্যাত সেই অবহেলিত তেমুজিন।

১২০৬ থেকে ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দ-মাত্র ২১ বছরে মরুচারী দুর্ধর্ষ এই বেদুইনদের নিয়েই তিনি গঠন করেন সর্বকালের সর্ববৃহৎ ও অবিভক্ত এক গ্রেটেস্ট স্টেট-মোঙ্গল সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর সময় যার পরিধি ছিল উত্তর চীন, পারস্য, মধ্য-পূর্ব-এশিয়া ও ইউরেশিয়া অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত। আধুনিক তুরস্ক, রাশিয়া, জর্জিয়া, আরমেনিয়া, পাকিস্তান এমনকি অখন্ড কোরিয়াও তখন ছিল মোঙ্গল শাসনাধীন।
চেঙ্গিস খান গঠিত মোঙ্গল এই জাতিসত্তা হচ্ছে পৃথিবীর জ্ঞাত ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বর্বর-অসভ্য একটা সম্প্রদায়। হয়তো প্রস্তর যুগেও এদের মতো নির্বোধ, অজ্ঞ আর নিষ্ঠুর কোনো প্রজাতি এ ভূমণ্ডলে ছিল না। এদের নির্মমতার সঠিক মাত্রার শব্দ জোগাতে অভিধান নিশ্চিতভাবেই অক্ষম। হিংস্র, রক্তপায়ী, নরখাদক, পিশাচ-এসব অভিধা আসলেই যথেষ্ট নয় এদের জন্য। একমাত্র ইয়াজুজ-মাজুজের তান্ডবের সঙ্গেই চলে এদের তুলনা। গতির তীব্রতায় যেমন, তেমনই ধ্বংসের নিষ্ঠুরতায়। বিজিত জাতির সঙ্গে ক্ষমা, দয়া, সহানুভূতি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল এদের কাছে অকল্পনীয়। সৃষ্টির বিপরীতে ধ্বংসই ছিল এদের মূল লক্ষ্য। আলো ঝলমল বলখ, বুখারা, সমরকন্দ, বাগদাদ, দামেশক এদের নখরাঘাতে রূপান্তরিত হয়েছিল সত্যিকারের মৃত্যুপুরীতে। যে ধ্বংসের পুনর্গঠন-প্রক্রিয়া সারতে মানবজাতির লেগেছিল ৫০০ বছর। এদের রোষ যেসব নগরীর ওপর সর্বাধিক পড়েছিল, পরবর্তী কয়েক যুগ সেগুলো নিরেট জঙ্গল হিসেবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে গিয়েছিল। কারণ, এরা যে ভূখণ্ডে হামলে পড়ত, সেখানকার মানুষ তো বটেই; কোনো প্রাণীকেও জীবন্ত ছাড়ত না।

বিজয়ী জাতি সাধারণত বিজিতদের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, কৃষ্টি, সভ্যতার ভালো দিকগুলো গ্রহণ করে নিজেদের জীবনযাত্রা, সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে থাকে; কিন্তু এরা ছিল ভিন্ন ধাঁচের। এরা সভ্যতা বিনির্মাণ নয়, গুঁড়িয়ে দিয়েই পরমানন্দ লাভ করত। তাই লাখ লাখ গ্রন্থের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি যেমন এরা নির্দ্বিধায় জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিত, তেমনই নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দিত তিলোত্তমা অট্টালিকা, সুরম্য প্রাসাদসমূহও। এরা জানত না, আদর্শহীন শক্তির স্থায়িত্ব হয় কচুপাতার পানির মতোই ঠুনকো। এ জন্যই তো মধ্যযুগের দোর্দণ্ড মোঙ্গল সাম্রাজ্য এখন শুধুই অস্তিত্বহীন ইতিহাস মাত্র। একসময় প্রায় পুরো বিশ্বকে শাসন করা সেই মঙ্গোলিয়া বিশ্বদরবারে আজ নিঃস্ব, রিক্ত, অনাথ হয়েই টিকে আছে।
এই মোঙ্গলরা ছিল নিরক্ষর, মূর্খ; বিধায় সভ্যতা-সংস্কৃতি এদের কাছে ছিল খেলো একটা বিষয়। এরা ছিল মরুচারী যাযাবর। তাই নগর কাঠামো ছিল এদের কাছে অসহ্য। ধর্মীয়ভাবে ছিল ভিন্ন-ভিন্ন ঘরানার। অধিকাংশই ছিল সামানবাদি, সূর্যপূজারি। চেঙ্গিস খানও ছিল কল্পিত ওই ধর্মের অনুসারী। তবে উল্লেখযোগ্য একটা অংশ বৌদ্ধও ছিল। কসাই হালাকু খান শেষ সময়ে এসে এই বৌদ্ধ ধর্মই গ্রহণ করে। তেমনই একটা অংশ ছিল খ্রিষ্টান। আইন জালুতের প্রধান সেনাপতি কিতবুগা, এমনকি হালাকু খান পত্নী ডোকুজ খাতুনও ছিল নেস্টারিয়ান খ্রিষ্টান। তা ছাড়া মুসলমানও ছিল কিছুসংখ্যক। তাই সাধারণ মোঙ্গলরা শিয়াল, সাপ, ব্যাঙ, কুকুর, শুকরসহ সব ধরনের হিংস্র জানোয়ার গণহারে ভক্ষণ করলেও মুসলিম মোঙ্গলরা এগুলো সতর্কভাবেই এড়িয়ে চলত, ঘৃণা করত। কথিত আছে, মোঙ্গলরা প্রয়োজনের সময় নিজের ঘোড়ার পিঠে ছুরি বসিয়ে ঘোড়ার তাজা রক্ত খেয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণ করত; কিন্তু মুসলিম মোঙ্গলরা এসব নোংরামির ধারেও ভিড়ত না।
ফলে ওরা ছিল অন্যদের চক্ষুশূল। মুসলিমদের ব্যতিক্রমী কালচারের কারণে পুরো মুসলিম জাতিসত্তার ওপরই সাধারণ মোঙ্গলরা ছিল খ্যাপা। আর এ কারণেই সম্ভবত মোঙ্গল ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলিম জাহান। লন্ডভন্ড হয়েছে ইসলামি সভ্যতা।
ইমরান আহমাদ