আসমানি ধর্ম, নবুয়তের তালিম, নবুয়তি মাদরাসার ফিকির ও ভাবনা বস্তুবাদী দর্শন ও চিন্তার সম্পূর্ণই বিপরীত। ইসলামি তরয ও ফিকির বস্তুপূজা ও দুনিয়া নিয়ে লিপ্ত থাকার চিন্তা-ভাবনার সম্পূর্ণ খেলাফ ও সাংঘর্ষিক। বস্তুবাদের বোল-চাল হল, দুনিয়ার জীবন-যিন্দেগিই সবকিছু। তার সকল ফন্দি-ফিকিরই হল, দুনিয়াকে আরো বেশি পছন্দনীয়, প্রকাশময় প্রদর্শনীয় করে তোলা। তার সব চিন্তা-ভাবনা, বিরামহীন চেষ্টা-ফিকিরই হল দুনিয়াকে আমোদ-প্রমোদময় করে তোলা। তার সব নিবিষ্টতা ও নিমগ্নতাই হল দুনিয়াকে বেশির থেকে বেশি আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসী করে তোলা। এগুলোই হল, বস্তুপূজারি দুনিয়া-পাগল বস্তুবাদী দর্শনের মাকসাদ; চেষ্টা ও লক্ষ্য।
আর নবুয়তের নোকতায়ে নযর ও আসল লক্ষ্যই হল-আখেরাত। নবুয়তি মাদরাসার মনযিল হল, মৃত্যুপরবর্তী অনন্ত জীবন। ঈমান ও ইসলামের গন্তব্য হল, অসীম নেয়ামতপূর্ণ চিরসুখের জান্নাত। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার ব্যাপারে কোরআন মাজিদ আমাদের বারবার সতর্ক করেছে। প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোবারক বাণীতেও দুনিয়ার হাকিকত বড় স্পষ্ট ও জ্বলজ্বলমান হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি প্রায়ই বলতেন:
اللَّهُمَّ لَا عَيْشَ إِلَّا عَيْشُ الْآخِرَهُ.
আয় আল্লাহ, জীবন তো আখেরাতের জীবনই। (সহিহ বোখারি: ২৭৪১)
ক্ষণিকের দুনিয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দোয়া ছিল:
اللَّهُمَّ اجْعَلْ رِزْقَ آلِ مُحَمَّدٍ قُوتًا وَفي رواية كَفَافًا.
আয় আল্লাহ, মুহাম্মদের পরিবারের রিযিক জরুরত মতো (পরিমিত) দান করুন। অন্য বর্ণনায় আছে: এতটুকু দিন, যা তাদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম: ১৭৪৭)
এক হাদিসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি সহজ উপমা দিয়ে দুনিয়ার তুচ্ছতাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। হযরত মুসতাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছি:
وَاللَّهِ مَا الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا مِثْلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ فِي الْيَمِّ فَلْيَنْظُرُ بِمَ تَرْجِعُ
আল্লাহর কসম! দুনিয়া আখেরাতের তুলনায় এতটুকুই, যেমন তোমাদের কোনো একজন তার আঙ্গুল সাগরের পানিতে ডুবালো। এরপর দেখো, কতটুকু পানি তার আঙুলের সঙ্গে উঠে এলো। -(সহিহ মুসলিম: ৫১০১)

দুনিয়া অস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী। এতে মন লাগানোর কিছু নেই। এটার মধ্যে লিপ্ত হওয়ারও কিছু নেই। এর সব জৌলুস অস্থায়ী। এর সব চাঙ্গা-রাঙ্গা রূপ-রস ক্ষণিকের। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সিরাত ও জীবনী এ আকিদা-বিশ্বাসে, অনুভূতি-অনুভবে, গওর-ফিকিরে কাটানো একটি স্বচ্ছ-সুন্দর, নির্মল-নির্দাগ ছবি ও চিত্র-যেন একটি অমলিন সাদা আয়না।
নবীজির অন্যতম সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি চাটাইয়ের ওপর আরাম-বিশ্রাম করতেন। চাটাইয়ের দাগ তাঁর শরীর মোবারকে প্রকাশ্যমান ছিল। আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল! আমাদের অনুমতি দিলে একটা কিছু চাটাইয়ের ওপর বিছিয়ে দেব।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক! আমার ও দুনিয়ার মেছাল তো ব্যস ওই মুসাফিরের মতো, যে একটা গাছের ছায়ায় বসে সামান্য কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামনেয়। এর পর সেটাকে ছেড়ে-রেখে নিজের গন্তব্যের দিকে চলতে শুরু করে। -(মুসনাদে আহমাদ: ৩৫২৫; তিরমিযি: ২২৯৯; ইবনে মাযাহ : ৪০৯৯)
হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাযির হলাম। তখন তিনি একটি চাটাইয়ের ওপর আরাম করছিলেন। তাঁর ও চাটাইয়ের মাঝে অন্য কোনো বিছানা ছিল না। চাটাইয়ের দাগ তাঁর বাহুতে প্রকাশমান ছিল। তিনি চামড়ার একটি বালিশে হেলান দিয়ে ছিলেন। যেটির মধ্যে কিছু ঘাস ও ছিলকা ভরা ছিল। আমি তাকে সালাম করলাম।… (কিছু কথাবার্তার পর) আমি ঘরের মধ্যে দৃষ্টি বোলালাম। আল্লাহর কসম! তার মধ্যে এমন কিছু ছিল না, যা আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করতে পারে। চামড়ার তিনটা টুকরা ছাড়া ঘরে আর কিছু ছিল না।
আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল, দোয়া করুন। আল্লাহ তায়ালা আপনার উম্মতকে যেন সমৃদ্ধি দান করেন। ইরানি ও রোমীয়দের কাছে তো ভরপুর দুনিয়াবি সামগ্রী; অথচ তারা আল্লাহর ইবাদতও করে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শোনামাত্র উঠে বসে গেলেন। বললেন, ইবনে খাত্তাব! তুমিও এমনটা ভাবো? ওরা তো ওইসব লোক, যারা নিজেদের প্রাপ্তির পুরাটাই এ দুনিয়ায় পেয়ে যাচ্ছে! (সহিহ বোখারি: ৪৭৯২)
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.