১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ-বাগদাদের মসনদে সমাসীন বয়োবৃদ্ধ খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহ। টানা ৫০৭ বছরের আব্বাসি খিলাফতের প্রথম পর্বের তিনিই শেষ খলিফা। উজিরে আজম ইবনু আলকামির বিশ্বাসঘাতকতা, শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা এবং খলিফার নির্বিকারতা বাগদাদের আব্বাসি খিলাফতের পতন ডেকে আনে। খলিফা এসব ব্যাপারে ছিলেন সম্পূর্ণ বেখবর, উদাসীন; কিন্তু খলিফাপুত্ররা ছিলেন সচেতন, জাগরুক। তারা ইবনু আলকামির এসব ভন্ডামি রুখে দাঁড়ান। খলিফার দরবারে তারা ইবনু আলকামির মুখোশ খুলে দেন। সহিংসতায় ইবনু আলকামির সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হওয়ায় খলিফা তার ওপর বেজায় চটে যান, তিরস্কার করেন।
খলিফার ভর্ৎসনায় ইবনু আলকামি প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসে ওঠেন। চরম প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্পে দিশেহারা হয়ে পড়েন। ইবনু আলকামি শুধু দুষ্ট প্রকৃতিরই ছিলেন না, ছিলেন একজন ধুরন্ধর উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি। স্রেফ উজির হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাননি, বাগদাদের ভাবি শাসক হিসেবেও নিজেকে কল্পনা করতেন দিনরাত। মনের কোণে লালন করা সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবার বহুগুণ উসকে ওঠে। মজ্জাগত সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এবং অসহনীয় অপমানের কঠিন প্রতিশোধ নিতে তিনি নিয়ে বসেন এক চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। হালাকু খানের কাছে বাগদাদ আক্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে দূত পাঠান। এমনকি তাকে বাগদাদের ভবিষ্যৎ শাসক করার শর্তে বাগদাদ অভিযানে তাকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেন।

সুন্নি খিলাফতের শিয়া উজির ইবনু আলকামির তরফ থেকে বাগদাদ ধ্বংসের আমন্ত্রণ আসে হালাকু খানের টেবিলে। সেখানেও ঘাপটি মেরে ছিলেন আরেক শিয়া। হালাকু খানের পরামর্শক নাসিরুদ্দিন তুসি। তিনি প্রাণান্ত প্রয়াসে বাগদাদ আক্রমণে হালাকু খানকে প্ররোচিত করতে থাকেন; কিন্তু হালাকু খান ছিলেন এ ব্যাপারে নিরাবেগ, নিস্পৃহ। তার মনের কোণে যদিও স্বপ্নের নগরী বাগদাদ দখলের সুপ্ত বাসনা ছিল; কিন্তু মুসলিমভীতি ছিল এরচেয়েও প্রচণ্ড। তা ছাড়া বাগদাদ ছিল ঐতিহ্যবাহী ইসলামি সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। মুসলিম দুনিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। বিশাল-বিস্তৃত ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী। তখনকার বাস্তবতায় এর দিকে হাত বাড়ানো চাট্টিখানি কথা ছিল না। তাই রূপকথার অনবদ্য এ নগরী আক্রমণ করতে মনে জোর পাচ্ছিলেন না। তিনি প্রবল প্রতিক্রিয়া ও তুমুল প্রতিরোধের আশঙ্কায় ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলেন; কিন্তু নাসিরুদ্দিন তুসি ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। ইনিয়ে-বিনিয়ে অবশেষে তিনি হালাকু খানকে রাজি করিয়ে ফেলেন। হালাকু খান শর্ত দেন, যেকোনো অজুহাতে ইবনু আলকামিকে অবশ্যই বাগদাদ সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা সংকুচিত করে ফেলতে হবে।
হালাকু খানের এ শর্ত বাস্তবায়নে ইবনু আলকামি এবার উঠেপড়ে লাগেন। খলিফাকে বোঝান, ‘বাগদাদ মুসলিমবিশ্বের রাজধানী, তাই এ শহরে কোনো শত্রুবাহিনী আক্রমণ দূরে থাক, সে চিন্তাও কখনো করবে না। অতএব, এত সৈন্য পোষে কী লাভ? খামোখাই রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হচ্ছে। সৈন্যসংখ্যা হ্রাস করলে শিগগিরই কোষাগার স্ফীত হয়ে ওঠবে।’ ইবনু আলকামির দেখানো শ্বেত মুলোয় খলিফার লোভাতুর চোখ দুটি চকচক করে ওঠে। আগপিছ না ভেবেই তিনি তৎক্ষণাৎ সেনা ছাঁটাইয়ের হুকুম দিয়ে দেন।
ইবনু আলকামি সুযোগ পেয়ে দ্রুত বেছে বেছে প্রতিভাবান সেনাদের ছাঁটাই করতে শুরু করেন। যুবরাজদের প্রবল আপত্তির মুখেও এ গণছাঁটাই অভিযান চলতে থাকে। অল্পদিনেই বাগদাদ সেনাবাহিনী রূপান্তরিত হয় নখ-দন্তহীন এক নিষ্কর্মা সেনা ইউনিটে। একপর্যায়ে হালাকু খানের কাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেলে ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি ২ লাখ মোঙ্গল সেনা নিয়ে অবরোধ করে বসেন রূপকথার বাগদাদ নগরী।

মোঙ্গল, চায়নিজ, আরমেনীয় খ্রিষ্টান ও এন্টিয়কের ক্রুসেডারদের নিয়ে গড়া ২ লাখ সৈন্যের সুবিশাল বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ বাগদাদ। ৯০ ফুট উঁচু অনতিক্রম্য শহররক্ষা পাঁচিলের ভেতরে হাঁসফাঁস করছে ২০ লাখ নগরবাসী। ছাঁটাইয়ের পর নিয়মিত বাহিনীতে এখনো ৫০ হাজার সৈন্য বিদ্যমান; কিন্তু আব্বাসি খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহ তাঁর সৈন্যদের শহরের বাইরে নিয়ে গিয়ে মোঙ্গলদের রুখে দাঁড়াননি। স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করে কার্যকর প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগও নেননি। অবশ্য মানসিক সে শক্তি, সাহস, উদ্যম, যোগ্যতা-কোনোটিই তাঁর ছিল না। হালাকু খান বিনা বাধায় জায়গায় জায়গায় নাফতুন (বিশালকায় পাথর নিক্ষেপক যন্ত্র) বসিয়ে অবরোধ শুরু করেন এবং দুর্ভেদ্য পাঁচিলগাত্রে ক্রমাগত ভারি পাথর বর্ষণ করে যেতে থাকেন। খলিফা তখনো মোঙ্গলদের অবরোধ ভাঙার বা বিধ্বংসী নাফতুনগুলো ধ্বংস করতে তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীকে নির্দেশ দেননি; বরং এটাই ঐতিহাসিক সত্য, বাগদাদের সুদৃঢ় প্রাচীরের উপর যখন দফায় দফায় অগ্নিগোলক নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল, খলিফা তখনো ছিলেন উদাসীন।
অবশ্য খলিফা নেতৃত্ব না দিলেও জাত্যভিমানী যুবরাজদের প্রচেষ্টায় বাগদাদ বাহিনী একাধিকবার শহর ছেড়ে বেরিয়ে এসে প্রচন্ড আক্রমণ ঠিকই শাণিয়েছে; কিন্তু মোঙ্গল সয়লাবের সামনে আনকোরা এ বাহিনী কখনোই জমে দাঁড়াতে পারেনি। বার বার ব্যর্থ হওয়ায় সেনাবাহিনীসহ নেতৃত্বহীন নগরবাসীর মনোবল অনেকটা ভেঙে পড়ে।
এদিকে মোঙ্গল অগ্নিগোলকের প্রচণ্ডতায় একসময় ঘুম ভাঙে খলিফার। তিনি জেগে ওঠেন; তবে চিতা হয়ে নয়, শিয়াল হয়ে। গা ছমছম করা মোঙ্গল নাকারায় ভীত হয়ে পড়েন। তখন গাদ্দার ইবনু আলকামি রং চড়িয়ে খাওয়ারিজম ধ্বংসের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে তাঁকে আরও বিপর্যন্ত করে তোলে। ‘একমাত্র আত্মসমর্পণ করলেই প্রাণে বাঁচা সম্ভব, আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীদের মোঙ্গলরা কোনো দয়াই করে না’- অহর্নিশ এসব কানমন্ত্র দিয়ে খলিফাকে দেশ-জাতির রক্ষার বাস্তবিক কোনো উদ্যোগ নিতেও দেয়নি সেই হারামি ইবনু আলকামি। একদিন ইবনু আলকামির কথায় সম্মত হয়ে খলিফা হালাকু খানের মত জানতে চান। হালাকু খান খলিফার সমস্ত ধনরত্ন সমর্পণ করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বলেন। অবশেষে তা-ই হয়। খলিফার সমস্ত ধনসম্পদ হালাকু খানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১০ ফেব্রুয়ারি মাত্র ২১ দিন অবরোধের পর দুর্বলচেতা খলিফা আত্মসমর্পণ করেন। মোঙ্গলদের জন্য দ্বার খুলে দেওয়া হয় বাগদাদের। হালাকু খানের আদেশে বৃদ্ধ আরামপ্রিয় খলিফাকে গালিচায় মুড়িয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পতন ঘটে টানা ৫০৭ বছর ধরে চলা জাঁকজমকপূর্ণ আব্বাসি খিলাফতের। ইতিহাস টেনে দেয় তার ঘটনাবহুল একটি অধ্যায়ের সমাপ্তিরেখা। বিশ্ববাসীর জন্য রেখে যায় অনেক উপদেশ সম্ভার, শিক্ষণীয় অজস্র বাণী-চিরন্তনীর ভান্ডার।