পৃথিবীর উন্নত জাতিগুলোর ( মুসলিম, খ্রিস্টান ) নিজস্ব জাতীয়তাবোধ ও ঐতিহ্যের জন্যে গৌরব করা উচিত। এছাড়া কোনো উন্নত জাতির জন্য উচিত তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহাসিক মূল্যবোধগুলো সকলের সামনে তুলে ধরা। তাহলে সে জাতির অধঃস্তর জেনারেশন তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে; আর পারে তার ঐতিহ্য চেতনাকে টিকিয়ে রাখতে। আর এইভাবে গঠিত ও গড়ে উঠা কোনো জাতিই পারে দেশের গৌরব ও সম্মান রক্ষার্থে তার জান-মাল সব কিছু লুটিয়ে দিতে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধরনের জাতীয়তাবোধ কোথায় পাওয়া যেতে পারে।
ইসলাম ব্যতীত পৃথিবীর কোনো ধর্মমত ও আদর্শে এই ধরনের জাতীয়তাবোধের অস্তিত্ব মিলবে না। ইসলামই জাতীয়তা সম্পর্কে এমনই একটি ধারণা পেশ করেছে। ফলে যেখানে প্রেম ও দয়া, ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠা এবং আত্মচেতনা ও আত্মগৌরবের মতো মহান গুণাবলির সম্বলিত জাতীয়তার ভিত্তিতে গড়ে উঠা জাতি প্রসঙ্গেই আল্লাহ তাআলা এই উক্তি করেছেন,
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ
অর্থ: তোমরা একটি উত্তম জাতি। বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।’
আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেছেন,
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا
অর্থ: এইভাবে আমি তোমাদের একটি মধ্যবর্তী উম্মতরূপে সৃষ্টি করেছি। উদ্দেশ্য হলো, তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষী হিসেবে গণ্য হবে এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষ্য দেবেন।’
অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে,
وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থ : প্রকৃতপক্ষে সম্মান তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের জন্যই রয়েছে।’
মোটকথা, যে উম্মত বা জাতির জন্য এতটা সম্মান ও গৌরব রয়েছে, সে জাতির তো উচিত সবকিছু আল্লাহ ও রাসূলের পথে উৎসর্গ করে দেওয়া।
ইসলামী জাতীয়তাবোধ দ্বারা উদ্বুদ্ধ জাতিসমূহ ও অন্যান্য জাতিগুলোর মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে। তবে ইসলামী জাতীয়তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ আত্মগৌরবশীল জাতিগুলোর দেখাদেখি অনেক নতুন জাতি ও তাদের বংশধরদের মধ্যে অনুরূপ চেতনাবোধ জাগাবার চেষ্টা করেছে। তাই এক সময় আমাদের কানে এই স্লোগান এসে পৌঁছছে গোটা পৃথিবীর বাদশাহী ইটালীর জন্যই।
আবার কখনো শুনেছি-
‘জার্মানই শ্রেষ্ঠ জাতি।’-গোটা পৃথিবী শাসন করার মালিক জার্মানি।
আবার কখনো আমরা শুনতে পেয়েছি-
গোটা পৃথিবীর প্রকৃত মালিক হচ্ছে বৃটেন।
কিন্তু আমরা পূর্বেই বলেছি, জাতীয়তা ও জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে ইসলাম একটি স্বতন্ত্র ধারণা পেশ করেছে। একজন মুমিন ও ইসলামী নৃপতির লক্ষ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রশক্তি আল্লাহর নৈকট্যের মাধ্যম হিসাবে পেশ করা। আর পৃথিবীর অন্যান্য নৃপতির ও ক্ষমতাশালীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তি তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা।
ইসলামী জাতীয়তাবোধের লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর খেলাফত। সেখানে বংশীয় আধিপত্য, ভৌগোলিক সংকীর্ণতাবোধ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব একান্তই অচল। ইসলামী জাতীয়তার উদ্দেশ্যই হচ্ছে পৃথিবীর পথ প্রদর্শন এবং বিশ্ব মানবতার কল্যাণ সাধন।
কোরআনের ভাষায়,
تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ
অর্থ : তোমরা লোকদের সৎকাজের নির্দেশ দেবে, মন্দ ও অকল্যাণকর কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখবে এবং আল্লাহর উপর দৃঢ় ঈমান পোষণ করবে।’
মূলত, ইসলামী জাতীয়তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এটাই। অর্থাৎ ভালো ও কল্যাণমূলক কাজের বিস্তার, অন্যায় ও মন্দ কাজের প্রতি ঘৃণাবোধ। ভালো কাজ ও ভালো লোকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তার যথার্থ অনুসরণ। আর এর বদৌলতেই অতীতে ইসলামী জাতিগুলো পৃথিবীর মধ্যে একটি অতিশয় সম্মানজনক স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। যার কোনো নজীর পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি আজও পর্যন্ত দেখাতে সক্ষম হয়নি।
এর বিপরীত দিকে পাশ্চাত্যের জাতিগুলোর মধ্যে শোষণবৃত্তির এই মনোভাব আগাগোড়াই লক্ষ করা যায়। তারা দুনিয়ার অপরাপর জাতিগুলোর মোটেই পরোয়া করে না। এছাড়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতিগুলোর উপর হস্তক্ষেপই তাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ব্যাপার।

জাতীয়তা ও জাতীয়তাবোধের ভালো ও কল্যাণকর দিকগুলো কেবল ইসলামের মধ্যেই পাওয়া যাবে। আর প্রকৃতপক্ষে ইসলামের যারা সত্যিকার অনুসারী তাদের মধ্যে এই গুণাবলি প্রবিষ্ট হতে বাধ্য। ইসলামী জাতীয়তার আর একটি লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিকতা। তাই ইসলাম তার স্বর্ণযুগে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সীমা সম্প্রসার ও বিস্তার করেছে এবং রাষ্ট্রের কল্যাণ, স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক জান-মাল কোরবানির চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে। ইসলাম তার অনুসারীদের রাষ্ট্রের কল্যাণ ও স্বার্বভৌমত্বের জন্য আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ ও তাকীদ করেছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলমানের জন্মভূমি বলতে তাই বোঝায়, যেখানে সে সর্বপ্রথম ভূমিষ্ট হলো। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে আপরাপর ইসলামী তথা ইসলামী রাষ্ট্রগুলোও তার আওতায় এসে যায়। সেগুলোও তার নিজের দেশ হিসেবে গণ্য করবে। গোটা পৃথিবীতেই সে ইসলামের অনুশাসন ও বিধি-বিধান জারি ও বাস্তবায়িত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে।
কোরআনের ভাষায়,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ ۚ فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا
يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
অর্থ: তোমরা এমনিভাবে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো যাতে ফেতনা ফাসাদ দূরীভূত হয়ে যায় এবং জীবনব্যবস্থা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।’
এভাবে ইসলাম জাতীয়তার সে সংকীর্ণ ধারণা মূলোৎপাটিত করে একটি বিশ্বজনীন জাতীয়তার ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল করে দেয়।
আর প্রকৃত পক্ষে এর মধ্যেই কলাণ নিহিত রয়েছে।
আল্লাহ বলেন,
أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْتُكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَ انْثَى وَجَعَلْتُكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا .
অর্থ: হে মানব জাতি! আমি তোমাদের একটি মাত্র পুরুষ ও স্ত্রী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তোমাদের বিভিন্ন গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত করেছি। তা এজন্য, যাতে তোমরা পরস্পর পরস্পরকে জানতে পারো।’
শহীদ হাসানুল বান্না র.