দাজ্জালের আলামত হল কুফুরি ব্যাপকতা লাভ করা। নাস্তিকতার প্রসার ঘটা। ফেতনা-ফাসাদে পৃথিবী ভারাক্রান্ত হয়ে পড়া। মানুষ ও মানবতাকে, ন্যায় ও ন্যায্যতাকে বিপন্ন করে তোলা।
এর আগে যা কিছু আলোচিত হয়েছে, এগুলো সব বস্তুবাদী সভ্যতার স্বরূপ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর সভ্যতার চিত্র। যার শেষ গন্তব্য হল কুফর ও নাস্তিকতা এবং মানুষ ও মানবতাকে ধ্বংস ও বিপন্ন করে তোলা। বস্তুবাদী সভ্যতা ক্রমাগত এ পথেই চলছে। বর্তমানে সেই চলা অনেক গতিশীল। অনেক বেশি ধাবমান। বস্তুবাদী সভ্যতা মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মতচর্চার নামে ঈমান ও ইসলামকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করার যে ডঙ্কা বাজিয়ে চলছে, এর শেষ ও সমাপ্তি ঘটবে দাজ্জালের হাতে।
বস্তুবাদী সভ্যতার অনিষ্টতার কারণে দাজ্জাল খারাপ, এমনটা নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জাল সম্পর্কে যে পরিমাণ বিস্তারিত বর্ণনা ও বিবরণ দিয়েছেন এর থেকেই জানা যায়, দাজ্জাল কতটা ভয়ানক হবে। তিনি দাজ্জাল সম্পর্কে যে পরিমাণ সজাগ ও সতর্ক করেছেন, দাজ্জালের ফেতনা সম্পর্কে যে পরিমাণ তাকিদ ও গুরুত্ব দিয়েছেন, এতেই বোঝা যায় সেটা কতটা ক্ষতিকর হবে। তিনি দাজ্জালের ফাঁদ ও ধোঁকাবাজি সম্পর্কে, তার নির্যাতন ও নিপীড়ন সম্পর্কে যে পরিমাণ ভীত-সন্ত্রস্ত করেছেন, তাতেই বোঝা যায় দাজ্জালের ফেতনা কতটা বিভীষিকাময় হবে। বস্তুবাদী ও জাগতিক সব ক্ষমতা ও সক্ষমতা দাজ্জালের থাকবে।
তার চলা ও কাজের গতি খুবই ক্ষিপ্র। কাল্পনিক ও অকল্পনীয় সব কাজ করে সে মানুষকে হতভম্ব করে দেবে। তার শক্তি-সামর্থ্য এবং ভালো-মন্দ করার ক্ষমতা দেখে মানুষ ঈমানি সংশয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু দাজ্জাল হল একটা ফেতনাবাজ। ফাসাদ ও বিপর্যয়ে সারা দুনিয়াকে তাবাহ ও বরবাদকারী। পৃথিবী জুড়ে অস্থিরতা ও অশান্তি সৃষ্টিকারী। যার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে বারবার সতর্ক করেছেন। দাজ্জালের সব ধরনের চক্রান্ত ও মকরবাজিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে পরিষ্কার ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
দুনিয়াবি উপায়-উপকরণ, শক্তি-সামর্থ্য এবং জাগতিক বস্তুর ওপর ক্ষমতা ও প্রভাব হযরত সুলাইমান আ.-ও প্রাপ্ত হয়েছিলেন; যুলকারনাইনও পেয়েছিলেন। কোরআন মাজিদ তাদের দুজনের শক্তি-সামর্থ্যের কথা বর্ণনা করেছে। তাদের দুরন্ত ও দুর্বার বেগে ছুটে চলার সক্ষমতার কথাও আলোচনা করেছে।
এখানে আমাদের ভাবার বিষয়টি হল, সেই পার্থক্যকারী সীমারেখা কোনটি, যা হযরত সুলাইমান ও যুলাকারনাইনকে দাজ্জাল থেকে পৃথক ও আলাদা করে দিয়েছে। আমাদের চিন্তা করার বিষয়, তাদের মধ্যে পার্থক্যকারী সেই সূক্ষ্ম-রেখা কোনটি, যা একজন নেককার বাদশার প্রশংসায় কোরআন মাজিদে বর্ণিত হয়েছে:
অর্থ: (সুলাইমান) বড়ই উত্তম বান্দা! নিশ্চয়ই সে ছিল অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী। -(সূরা সদ: ৩০)
এ পার্থক্যকারী সীমারেখা হল, ঈমান; ইসলাম। হযরত সুলাইমান আ. ও যুলকারনাইন তাদের শক্তি-সামর্থ্যকে ব্যয় করেছেন মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে। খোলাফায়ে রাশেদা এবং যুগে যুগে ইসলামের সত্যিকার শাসকরাও তা-ই করেছেন। তাদের মধ্যেও অনন্য শক্তি সামর্থ্য ছিল। বিস্তৃত ক্ষমতা ও ব্যাপক সক্ষমতা ছিল। দীর্ঘ দিন ক্ষমতার স্থায়িত্ব ছিল। তাদের মধ্যে রাজ্যপরিচালনার হেকমত ও কৌশল ছিল। আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তা ও বিস্ময়কর দূরদর্শিতা ছিল।
তাদের এ সবকিছু ব্যবহারের ক্ষেত্র ও লক্ষ্য ছিল, মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা। তারা নিজেদের সব ধরনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, মেধা ও বুদ্ধি, শক্তি ও সামর্থ্য, যোগ্যতা ও সক্ষমতাকে মানুষের কল্যাণ ও সফলতার জন্য ব্যয় করেছেন। জগতের মাঝে সত্য ও সততা, সাম্য ও সমতা, ন্যায় ও ইনসাফ কায়েমের জন্য ব্যবহার করেছেন। তাদের সকল বাসনা ও সাধনা ছিল, ঈমান ও ইসলাম গ্রহণ করে মানুষ যেন চিরস্থায়ী কল্যাণ ও সফলতা অর্জন করতে পারে।

হযরত সুলাইমান আ., যুলকারনাইন, খোলাফায়ে রাশেদা ও নেককার শাসকগণ সুন্দর ও উত্তম গুণাবলির সমাবেশ ও সমষ্টি ছিলেন। তাদের মাঝে সব ধরনের ভালো গুণের সম্মিলন ছিলেন। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা এসব নেককার শাসকদের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য জানিয়ে দিচ্ছেন:
অর্থ: তারা (নেককার শাসকরা) এমন, আমি যদি দুনিয়ায় তাদের ক্ষমতা দান করি, তা হলে তারা নামায কায়েম (এর কানুন ও পরিবেশ) করবে, যাকাত আদায় (এর ব্যাপারে লোকদের উৎসাহী ও অগ্রগামী) করবে, মানুষকে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দেবে। আর সব কাজের পরিণতি আল্লাহরই হাতে। -(সূরা হজ: ৪১)
অন্য সূরায় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান:
অর্থ: আর পরকালীন নিবাস তো আমি সেসব লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। আর শেষের শুভ পরিণাম তো মুত্তাকিদের জন্যই। (সূরা কাসাস:৮৩)
এর বিপরীতে দাজ্জালের পরিচয় নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে বলেছেন, তা হল কুফর। এ শব্দটা অনেক ব্যাপক অর্থকে শামিল করে। হাদিস শরিফে আছে: দাজ্জালের দু’ চোখের মাঝে, ত এ (কাফের) লেখা থাকবে।
যা প্রত্যেক মুমিন পড়তে পারবে-চাই সে পড়ালেখা জানুক বা না জানুক। (সহিহ বোখারি, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ২০৮২৭)
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.