প্রবাদ আছে, দূরদর্শিতাই মানুষকে মহান করে তোলে। আর সেই দূরদর্শিতাই যে ২১ বছর বয়সের যুবককে মহান করে তুলবে, সেটা কেউ ভাবতেই পারেনি। ৫৭২ বছর আগে সেই যুবক কনস্ট্যান্টিনোপোল (ইস্তানবুল) জয় করে এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে এক মরণঘাতী আঘাত দিয়েছিলেন। সেই যুবক আর কেউ নয়, সে ছিল মহান ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ৭ম সুলতান, ফাতিহ সুলতান মেহমেদ খান । মাত্র ২১ বছর বয়সে ইস্তাম্বুল জয় করেন মেহমেদ, অটোমান সাম্রাজ্যকে বিরাট রূপান্তরের পথে নিয়ে যান।

সুলতান মেহমেদ ফাতিহ ১৪৩২ সালের ৩০ মার্চ এদির্নে জন্মগ্রহণ করেন, যা তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। তার বাবা সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ছিলেন ওসমানীয় শাসক। মেহমেদ দুই বছর বয়স পর্যন্ত এদির্নে ছিলেন। ১৪৩৪ সালে তাকে আমাসিয়ায় পাঠানো হয়, যেখানে তার বড় ভাই ১৪ বছর বয়সী আহমেদ এবং তার ছোট ভাই আলাউদ্দিন আলীর সাথে একটি সানজাকের গভর্নর ছিলেন।
মেহমেদের শিক্ষার জন্য তার বাবা বিভিন্ন শিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু মেহমেদ, যেমনি বুদ্ধিমান ছিলেন, তেমনি যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন, তাকে শিক্ষিত করা সহজ ছিল না। মেহমেদকে ইসলামী এবং পাশ্চাত্য উভয় শিক্ষকই শিক্ষা দিতেন। যদিও তাকে সামরিক বিজয়ের জন্য মূলত কৃতিত্ব দেওয়া হয় তবুও দর্শন, শিল্প এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তার অবদান মূল্যবান।
মেহমেদ ফার্সি, আরবি, প্রাচীন গ্রীক এবং ইতালীয় ভাষায় কথা বলতেন বলে মনে করা হয় – যেই বিষয়টিকে অনেকে পশ্চিম এবং পূর্বে একইভাবে বিস্তৃত একটি সাম্রাজ্য গঠনের তার আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত হিসাবে দেখেন।
তুর্কি ইতিহাসবিদরা বলেছেন যে তার লাইব্রেরিতে জ্যামিতি, ধর্ম, প্রকৌশল, জ্যোতির্বিদ্যা, পাটিগণিত, প্রত্নতত্ত্ব, ভূগোল এবং দর্শনের মতো বিষয়ের বই ছিল।
কবি হিসেবে পরিচিত এই বিজেতার শিল্পকলায়ও প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। ওসমানীয় সুলতান সম্ভবত আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সাম্রাজ্য গঠনের সাধনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, কারণ তিনি কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে সামরিক অভিযান সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন।

মেহমেদ ছিলেন লম্বা, মোটা গাল, কুঁচকানো নাক, পেশীবহুল এবং শক্তিশালী সুলতান, যিনি পড়ালেখার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি ফার্সি এবং আরবি ভাষায় অনূদিত দার্শনিক রচনাগুলি পড়তেন। বৈজ্ঞানিক বিষয়ে তিনি পণ্ডিতদের পরীক্ষা করতেন, তারা যে ধর্ম বা সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, এবং তাদের রচনাগুলি লিখে রাখতেন।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সুলতান ও জনসাধারণের দৃষ্টিতে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য এবং ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে ওসমানীয়দের নাম লেখার জন্য, তার দৃষ্টি তখন বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের দিকে নিবদ্ধ ছিল।
তিনি দুইবার উসমানীয় সাম্রাজ্য শাসন করেন:
- প্রথম দফা: আগস্ট ১৪৪৪ – সেপ্টেম্বর ১৪৪৬
- দ্বিতীয় দফা: ফেব্রুয়ারি ১৪৫১ – মে ১৪৮১
দ্বিতীয়বার মসনদে বসার পর তাৎক্ষণিক ভাবে কনস্ট্যানটিনোপোল বিজয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
যদিও কনস্ট্যানটিনোপোল এর আগে ৩২ বার অবরুদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু কেউ কনস্ট্যানটিনোপোল দখল করতে সক্ষম হয়নি। সুলতান মেহমেদ ভাল করেই জানতেন যে, অসম্ভবকে অর্জন করার জন্য অপ্রচলিত কৌশল এবং অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন।

সুলতান ৮০ হাজার সেনাবাহিনী একত্রিত করেছিলেন এবং পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে শহরের শক্তিশালী দেয়ালের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, তিনি দুই লাখের বেশি, আবার কেউ মনে করেন ১ লক্ষ ২০ হাজারের মত। যেখানে ছিল তৎকালীন সর্ববৃহৎ কামান। সেই কামানের নাম দেওয়া হয়েছিল “শাহী”। যেই শাহিকে টেনে নিয়ে যেতে চল্লিশটি মহিষ লাগতো।
সামরিক অভিযান ৫০ দিনেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত ছিল। ২৯শে মে, শহরটি অবশেষে পতন লাভ করে, দ্বিতীয় মেহমেদ “বিজয়ী” উপাধি অর্জন করেন। এবং বিজয়ের পর শহরের নাম রাখা হয় “ইসলামবুল”। যা পরিবর্তন করে এখন ইস্তানবুল বলা হয়। এবং এদীর্ণে থেকে রাজধানী সরিয়ে ইস্তানবুলে না হয়, যার সীমানা দানিউব নদী থেকে কিজিলিরমাক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
মাত্র ২১ বছর বয়সে বিজেতা মেহমেদ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের ধুলোময় পাতায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন, ওসমানীয় রাষ্ট্রকে এমন একটি সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন যা আগামী শতাব্দী ধরে তিনটি মহাদেশের একাধিক অঞ্চলে রাজত্ব করে।
ফাতিহ্ সুলতান মেহমেদ খান পরবর্তী বছরগুলিতে আধুনিক তুর্কিয়ের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সার্বিয়া, মোরিয়া, ট্রেবিজোন্ড (আধুনিক ট্রাবজন) , বসনিয়া, আলবেনিয়া এবং বেশ কয়েকটি আনাতোলিয়ান (মধ্য তুর্কি) অঞ্চলের উপর ওসমানীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেন।

তিনি ১৪৮১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে ২৫টি সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বহু বিজয় অর্জনের ফলে, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ২২ লক্ষ বর্গকিলোমিটার (১৪ লক্ষ বর্গমাইল) এরও বেশি হয়ে যায়।
১৪৮০ সালে ইতালির ওট্রান্টোতে জয়লাভের পর, সুলতান মেহমেদ রোম বিজয়ের পরিকল্পনা করছিলেন। তবে, ৩রা মে, ১৪৮১ সালে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে, ভ্যাটিকানের গির্জাগুলোতে ঘণ্টা বাজানো হয় এবং রাস্তায় রাস্তায় মানুষরা খুশিতে নাচতে নাচতে বলতে থাকে “মহান ঈগল মারা গেছে”।
সুলতান মেহমেদ ফাতিহ খান, যিনি তার ৪৯ বছরের জীবনে ডজন ডজন লড়াই করেছেন এবং সবগুলোতেই বিজয়ী হয়েছিলেন। সেইসাথে ইতিহাসে এক অমোচনীয় চিহ্ন রেখে গেছেন এবং তার উত্তরাধিকার। তার মধ্যে অন্যতম ইয়াভুয সুলতান সেলিম খান (যিনি মাত্র আট বছরের শাসনে ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে প্রায় দুইগুণ বড় করেছিলেন, যা তার সকল পূর্বপুরুষ মিলেও করতে পারেনি) এবং সুলতান সুলেমান।