এইভাবে উন্নয়নশীল ও প্রগতি-প্রত্যাশী জাতিসমূহের জন্য প্রয়োজন রয়েছে সামরিক শক্তির বিকাশ সাধন। তাদের প্রতিটি যুবকের মধ্যে, তাদের কিশোরদের অন্তরে সিপাহীসুলভ উদ্যম ও তেজবীর্য থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে এই যুগে এর গুরুত্ব আরো বেশি। আজকাল সামরিক প্রস্তুতি ব্যতীত শান্তি ও সন্ধির প্রত্যাশা বৃথা।আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ইসলাম এই অধ্যায়টি পরিহার করেনি বরং এটাকে ইসলাম আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গণ্য করেছে। নামাজ রোজার মতো জিহাদও একটি অপরিহার্য দিকযা কোনো দীনদার মুসলমান উপেক্ষা করতে পারে না।বিশেষত, ইসলাম আল্লাহর পথে জিহাদকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, সামরিক প্রস্তুতির জন্য যতটা তাকীদ দিয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো মতাদর্শে তা দেওয়া হয়নি। কোরআন, হাদীস ও মহানবীর জীবন চরিত্র তথা ইসলামের সর্বত্রই এ বাস্তব দিকটিকে গুরুত্বসহকারে বর্ণনা করা হয়েছে।এই ব্যাপারে ইসলাম যে সব বিধান পেশ করেছে, তা পৃথিবীর কোনো ধর্মমত আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। নিম্নে বর্ণিত কোরআনের বাণীগুলোই তা প্রমাণ করে,
وَاعِدُّوا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ
অর্থ: যতটা সম্ভব তোমরা এ ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণ করো তোমাদের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করে এবং প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তোমাদের ঘোড়াগুলোও তৈরি রাখো। এই জন্য যে, এর দ্বারা তোমরা আল্লাহ এবং তোমাদের শত্রুদের ভীতসন্ত্রস্ত করতে পারবে।’
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ وَعَلَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَلَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ .
অর্থ: কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করা তোমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য করে দেওয়া হয়েছে। আর তোমরা এটাকে অপছন্দ করছ; অথচসেটা তোমাদের জন্য কল্যাণবহ। আর তোমরা এমন কিছুকে ভালোবাসছ, যা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর।’পৃথিবীতে এমন কোনো গ্রন্থ আছে কি, যার মধ্যে সামরিক প্রস্তুতি ও শত্রুর মোকাবেলা সম্বন্ধে এরূপ জরুরি নির্দেশ রয়েছে। এখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় ইবাদতের মতোই সামরিক প্রস্তুতির গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।
فَلْيُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يَشْرُونَ الْحَيُوةَ الدُّنْيَا بِالْآخِرَةِ
অর্থ: যারা দুনিয়ার জিন্দেগীর বিনিময়ে আখেরাতে সওদা গ্রহণ করতে চায়, তাদের উচিত আল্লাহর পথে লড়াই করা।২
এরপর আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের পুরস্কার সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
مَنْ يُقَاتِلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبُ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا
অর্থ: যারা আল্লাহর পথে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করে অথবা বিজয়ী হয় তাদের উভয় অবস্থাতেই আমি পুরস্কৃত করব।
مَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا ۚ وَاجْعَلْ
لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ نَصِيرًا
অর্থ: তোমাদের কি হয়েছে, তোমরা আল্লাহর পথে সে সব পুরুষ, স্ত্রী এবং শিশুদের জন্য লড়াই করছ না, অথচ তারা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা জানাচ্ছে, হে আমাদের প্রভু! আমাদের এ জনপদ থেকে বের করে নাও, যার অধিবাসীরা জালেম। হে, আল্লাহ! আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে একজন ওলি ও সাহায্যকারী পাঠাও।’
কোরআনের এই বাণীর মর্মার্থের প্রতি একটু লক্ষ করলেই আমরা বুঝতে পারি, অসহায়দের জন্য সংগ্রাম বা জিহাদ করা কতখানি পুণ্য ও কল্যাণের কাজ। আর যারা এ পথে সংগ্রাম করে তাদের উদ্দেশ্য কত মহান ও কত পবিত্র।
এর বিপরীত দিকে যারা অসহায় নারী-পুরুষদের প্রতি জুলুম করে তারা কতটা ঘৃণিত সমাজের বুকে আর অভিশপ্ত আল্লাহর নিকট। আল্লাহর পথে যারা এভাবে সংগ্রাম করে তারা শুধু মানবসমাজের ও নির্যাতিতদের নিকটই প্রশংসিত হয় না, আল্লাহর নিকটও তারা এর বিনিময়ে লাভ করবে পরম পারিতোষিক। কারণ তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই এ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে থাকে।
কোরআনের ভাষায়,
الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَنِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَنِ كَانَ ضَعِيفًا
অর্থ: যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে থাকে। আর কাফেরগণ তাগুত বা খোদাদ্রোহী শক্তির পথে সংগ্রাম করে থাকে। অতএব তোমরা সে খোদাদ্রোহী শক্তিচক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করো। আর জেনে রাখো শয়তানদের চাল একান্তই দুর্বল।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করা অবশ্য কর্তব্য। যারা এই কর্তব্য কর্মকে অবহেলা করে এ ক্ষেত্রে শৈথিল্য দেখায়; আল্লাহ তাআলা তাদের ভর্ৎসনা করেছেন অত্যন্ত তীব্রভাবে। ইসলামের দাবীর পরও যারা এ পথে শৈথিল্য প্রদর্শন করে তারা মূলত সত্যিকার পথ হতে দূরে সরে পড়ে এবং নিজেরাই পরিণামে হয় বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন। কারণ একথা অবধারিত, মৃত্যু একদিন এসেই যাবে। একে রোধ করার কোনো উপায় মানব সন্তানের নেই!
আল্লাহ বলেন,
الَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ قِيلَ لَهُمْ كُفُوًا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلوةَ وَاتُوا الزَّکٰوةَ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَخْشَوْنَ النَّاسَ كَخَشْيَةِ اللَّهِ أَوْ أَشَدَّ خَشْيَةٌ وَقَالُوا رَبَّنَا لِمَ كَتَبْتَ عَلَيْنَا الْقِتَالَ لَوْلَا أَخَّرْتَنَا إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ لِمَنِ اتَّقَى وَلَا تُظْلَمُونَ فَتِيلًا أَيْنَ مَا تَكُونُوا يُدْرِكُكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ
অর্থ: তুমি কি তাদের দেখ নাই যাদের বলা হয়েছিল, তোমাদের হাত সংযত রাখো, নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত প্রদান করো। অতঃপর তাদের উপর যখন যুদ্ধ ফরজ করে দেওয়া হলো, তখন তাদের মধ্যে থেকে একটি দল লোকদের এমনিভাবে ভয় করতে লাগল যেমনভাবে আল্লাহ ভয় করা হয়ে থাকে। অধিকন্তু তারা তাদেরকে আল্লাহর চেয়েও বেশি ভয় করতে লাগল।

তারা বলতে শুরু করল, হে আমাদের আল্লাহ! তুমি আমাদের উপর যুদ্ধ কেন ফরজ করে দিলে। আমাদের আরো কিছুদিন সময় দেওয়া হলো না কেন? তুমি বলে দাও, দুনিয়ার সামগ্রী ও লাভ খুবই অল্প। আর যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আখেরাতের জিন্দেগীতে এর চেয়েও বিপুল পরিমাণের সম্পদ ও সুখ-শান্তি রয়েছে। আর সেখানে তোমাদের বিন্দুমাত্র হক নষ্ট করা হবে না।
আর তোমাদের মৃত্যু অবধারিত-চাই তোমরা কোনো সুরক্ষিত দুর্গেই অবস্থান করো না কেন।’
আল্লাহর শপথ! পৃথিবীতে এমনি ধরনের জোরাল বক্তব্য ও ফরমান তোমরা আর কার থেকে আশা করতে পারো। একজন সেনাপতি ও তার সৈন্যবাহিনীকে উদ্দীপ্ত করার জন্য এর চেয়ে তেজোদ্দীপ্ত বাণী আর কোথায় পাওয়া যেতে পারে?
সৈন্যবাহিনীর জন্য সাধারণত দু’টি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি হচ্ছে শৃংখলা ও অপরটি হচ্ছে আনুগত্য। আর আল্লাহ পাক তাঁর এই বাণীতে এ দু’টি পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছেন।
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَّرْصُوصٌ
অর্থ: আল্লাহ তাদেরই ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধ হয়ে লড়াই করে। মনে হয় যেন সীসা ঢালা প্রাচীর।’
আজ আমাদের বিশেষভাবে স্মরণ করা দরকার, আল্লাহ পাক সমর প্রস্তুতির সামরিক শিক্ষা, শাহাদাতের গৌরব, আল্লাহর পথে দানের পুণ্য এবং মুজাহিদের পরিণাম-ফল প্রভৃতি সম্বন্ধে কতটা আশ্বস্ত করেছেন আমাদের। এ ব্যাপারে তোমাদের সঠিক ধারণা না হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর নিকট এর মূল্য ও কল্যাণ কোনোটাই অবিদিত নেই। আর এ জন্যই আল্লাহ তাআলা কালাম ও তার ব্যাখ্যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও তাঁর জীবন-চরিত্র এবং ফেকাহ শাস্ত্রের বিধানগুলোর সঠিক মূল্যায়নই আজ আমাদের এ সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা দিতে পারে।
আধুনিক বিশ্বের জাতিগুলোও এই বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। তারা এই বিষয়টি তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু মনে করে নিয়ে তার প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে। মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদ, হিটলারের নাৎসীবাদ এবং স্টালিনের কম্যুনিজমের ভিত্তিও এই সামরিক শক্তির উপরই নিভর্রশীল। তবে এর মধ্যে এবং ইসলামী সমর ও সৈন্য পরিচালন ব্যবস্থার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বিদ্যমান। ইসলাম যুদ্ধ-বিগ্রহ অনুমোদন করলেও সন্ধিকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। আল্লাহ বলেন,
إِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحُ لَهَا وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
অর্থ: হ্যাঁ, তারা যদি সন্ধির দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে তোমরা সেদিকে অগ্রসর হও এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।’
لَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ . الَّذِينَ إِنْ مَكَّنْهُمْ فِي الْأَرْضِ اقَامُوا الصَّلوةَ وَاتَوُا الزَّکٰوةَ وَاَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ
الْأَمُورِ
অর্থ: যে আল্লাহর সাহায্যে এগিয়ে আসবে, আল্লাহও তার সাহায্যে এগিয়ে আসবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অসীম শক্তির অধিকারী। তারা এমনই চরিত্রের লোক, তাদের যদি এই পৃথিবীর বুকে বিজয়ী করা হয়, তাহলে তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, জাকাতের ব্যবস্থা করবে এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে লোকদের বিরত রাখবে। আর পরিণাম ফল তো আল্লাহর হাতেই নিবন্ধ।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের কি করণীয় তাও বলা হয়েছে,
إِمَّا تَخَافَنَّ مِنْ قَوْمٍ خِيَانَةً فَانْبِذْ إِلَيْهِمْ عَلَى سَوَاءٍ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْخَائِنِينَ
অর্থ: কোনো জাতির পক্ষ থেকে যদি চুক্তি ভঙ্গ ও শঠতার আশংকা থাকে, তাহলে তাদের চুক্তিকে তাদের দিকে ছুড়ে ফেলো। কারণ, যারা খেয়ানতকারী আল্লাহ তাদের আদৌ পছন্দ করেন না।
এরপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খোলাফায়ে-রাশেদীন ইসলামী সৈন্য-বাহিনীর কমান্ডারদের যেসব নির্দেশ প্রদান করেছিলেন এ ক্ষেত্রে সেগুলোও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ধোঁকা দেওয়া চলবে না, আমানতের খেয়ানত করা যাবে না, কারো হাত-কান-নাক কেটে পঙ্গু করা যাবে না। আর তোমরা এমন সব লোকদের সম্মুখীন হবে, যারা পুরোহিত হিসেবে গির্জায়ই অবস্থান করছে। তোমরা তাদের যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই ছেড়ে দেবে।
ইসলামের সৈন্যবাহিনীর অবস্থা এটাই ছিল। তারা ইনসাফ ও ন্যায়ের খেলাফে এক কদমও অগ্রসর হতো না। এর মোকাবিলায় বর্তমান ইউরোপীয় সৈন্যবাহিনীর অবস্থা সবারই জানা থাকার কথা। এখানে জুলুম-নিষ্পেষণ ব্যতীত আর কিছুই নেই।
শহীদ হাসানুল বান্না রাহ