যে জীবন নবুয়তের ঝরণা থেকে উৎসারিত, তার বৈশিষ্ট্যই হল ইনসাফ, সাম্যতা, মধ্যপন্থা ও পরিমিতি। কোরআন তাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছে:
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا.
অর্থ: যখন তারা ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না। বরং তারা এতদুভয়ের (অপব্যয় ও কৃপণতার) মাঝে পরিমিতি ও মধ্যমপন্থার ওপর কায়েম থাকে। -(সূরা ফুরকান: ৬৭)
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, উম্মতে মুহাম্মদির গুণ ও বৈশিষ্ট্যই হল, পরিমিতি ও মধ্যমপন্থা।
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ
شَهِيدًا.
অর্থ: আমি তোমাদের এমন এক জাতি হিসেবে বানিয়েছি, যারা সব দিক থেকে ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থী’। যাতে তোমরা (অমুসলিম) মানুষের জন্য সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর। (সূরা বাকারা:১৪৩)
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থার এক অনন্য পূর্ণাঙ্গ মেছাল ছিলেন। প্রতিটি বিষয়ে ন্যায় ও ইনসাফ, এতেদাল ও সাম্যতা, সততা ও ন্যায্যতা, সুষমতা ও সুসামঞ্জস্যতা, মিতাচার ও পরিমিতি সম্পর্কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপদেশ নসিহত পরামর্শ তালিম ও তরবিয়ত শিক্ষাদান ও নির্দেশপ্রদানের কথা সিরাতের সব ক’টি কিতাবে সবিস্তারে বর্ণিত ও বিবৃত আছে।
হযরত আলি ইবনে আবি তালেব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কাজ ছিল এতেদাল। ন্যায়সঙ্গত ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থী। তিনি হক ও অধিকার বিষয়ে কোনো কমি করতেন না। আবার হক ও অধিকার বিষয়ে সীমাও ছাড়াতেন না। যখন কোনো দুটি কাজের মধ্যে একটিকে এখতিয়ার করার মওকা থাকত, সব সময় তিনি সহজটিকে গ্রহণ করতেন। (শামায়েলে তিরমিযি)
ইসলামের গুণাগুন ও বৈশিষ্ট্য হল, এতেদাল ও মধ্যপন্থা। ইসলাম সব ধরনের বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি, কঠোরতা ও শিথিলতা থেকে একদমই মুক্ত ও পবিত্র। তাই আল্লাহ তায়ালা দীন-ইসলামকে কখনো (৫) কইয়্যিমুন-সুপ্রতিষ্ঠিত বলেছেন। আবার কখনো (5) কিয়ামুন-সোজা সরল বলেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে ইরশাদ ফরমান:
قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِين.
অর্থ: বলে দাও, নিশ্চয় আমার রব আমাকে সোজা-সরল পথের হেদায়েত দিয়েছেন। এটিই সঠিক ও সুপ্রতিষ্ঠিত দীন। ইবরাহিমের আদর্শ-এক আল্লাহর জন্য হয়ে যাওয়া। আর ইবরাহিম কখনোই মুশরিকদের অন্তুর্ভুক্ত ছিল না। (সূরা আনআম: ১৬১)
অন্য জায়গায় আল্লাহ তায়ালা ইসলামের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন:
ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ.
অর্থ: এটি সুপ্রতিষ্ঠিত দীন-বিধান। (সূরা তাওবা: ৩৬)
আল্লাহ তায়ালা আরেক স্থানে ইসলামের পরিচয় দিচ্ছেন:
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ الْقَيْمِ.
অর্থ: তুমি বিশুদ্ধ দীনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখো। -(সূরা রোম: ৪৩)

কোরআন মাজিদকেও কইয়্যিমুন )قیم( বলা হয়েছে। তখন কইয়্যিমুন এর অর্থ হবে, কোরআন মাজিদ সব ধরনের ভ্রষ্টতা, বক্রতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে এবং অপকু, অনিশ্চিতি, অস্থায়িত্ব থেকে পবিত্র। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন:
لحَمْدُ للهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا . قَيْمًا لِيُنْذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِنْ لَدُنْهُ وَيُبَشِّرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا نا مَاكِثِينَ فِيهِ أَبَدًا.
অর্থ : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। যিনি নিজ বান্দার প্রতি কিতাব (কোরআন) নাযিল করেছেন। এবং তাতে কোনো রকমের ত্রুটি রাখেন নি। একদমই সরল-সোজা সুপ্রতিষ্ঠিত এক কিতাব (যা সব ধরনের ভ্রষ্টতা, বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে মুক্ত ও পবিত্র), যা তিনি নাযিল করেছেন মানুষকে নিজের তরফ থেকে এক কঠিন শান্তি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য। এবং যে সকল মুমিন নেক আমল করে, তাদের এ খোশখবর দেওয়ার জন্য, নিশ্চয় তাদের জন্য রয়েছে বড়ই উত্তম
প্রতিদান। তাতে তারা চিরদিন খোশহালে থাকবে। -(সূরা কাহাফ: ১-৩)
অন্য সূরায় আল্লাহ তায়ালা ন্যায় ও ইনসাফের ধর্ম দীন-ইসলামের পরিচয় দিচ্ছেন:
رَسُولٌ مِنَ اللَّهِ يَتْلُو صُحُفًا مُطَهَّرَةٌ فِيهَا كُتُبْ قَيْمَةٌ.
অর্থ : আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রাসূল, পবিত্র গ্রন্থ থেকে সে তেলাওয়াত করে শোনাবে। যাতে লেখা আছে সরল-সঠিক বিধান ও বিষয়। -(সূরা বায়্যিনা: ২-৩)
আল্লাহ তায়ালা অন্য সূরায় ভারসাম্যপূণ ন্যায়সঙ্গত ও পরিমিত ইসলামের পরিচয় দিচ্ছেন:
قُرْ أَنَا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ.
অর্থ: এটি আরবি কোরআন, এর মধ্যে কোনো বক্রতা-ভ্রষ্টতা নেই: যাতে মানুষ তাকওয়া অবলম্বন করে। -(সূরা যুমার: ২৮)
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, ন্যায়সঙ্গত মধ্যপন্থা ও হকের অনুসারীদের জন্য দীন-ইসলামের মধ্যে রয়েছে পরিপূর্ণ দ্যুতি ও গতি।
ইনসাফ ও ভারসাম্যতা ইসলামের প্রতিটি রগ ও রেশায় মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ইসলামের প্রতিটি নিয়মকানুন, প্রতিটি বিধান, ইসলামের গোটা তালিম ও তরবিয়ত, তাহযিব ও তামাদ্দুন সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে এতেদাল। ভারসাম্যতা ও ন্যায্যতা। মধ্যপন্থা ও পরিমিতি। সেইসঙ্গে নির্জীবতা ও উগ্রতা এবং ছাড়াছাড়ি ও বাড়াবাড়ির কোনো স্থান নেই ইসলামে।
এর বিপরীতে বস্তুবাদী সভ্যতায় নেই কোনো ইনসাফ; নেই কোনো সততা ও ন্যায্যতা; নেই ঈমান ও আমলের কোনো কদর; নেই আখলাক ও চরিত্রের কোনো মূল্য। ইউরোপ-আমেরিকাসহ গোটা পশ্চিমা সভ্যতা ও তার অনুসারীরা আজ ডুবে আছে অশান্তিময় এক রঙিন আঁধারে। যারা ঈমান ও আমলকে ছেড়ে দেওয়ার পর ন্যায় ও ইনসাফ, মধ্যপন্থা ও পরিমিতি থেকে মাহরুম হয়ে গেছে। তারা জীবনের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে, প্রতিটি কাজে ও কানুনে বক্রতার শিকার হচ্ছে। তাদের চিন্তা-ভাবনা ও আচার-আচরণে রয়েছে ছাড়াছাড়ি। জীবনের প্রতিটি বিষয় ও পদক্ষেপে রয়েছে বাড়াবাড়ি। তারা তাদের জীবনকে বানিয়ে নিয়েছে ঘুরানো-পেঁচানো। জীবনকে অতিরিক্ত সহজ করতে গিয়ে জটিলই করেছে কেবল। ঈমান ও ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে মনের খাহেশাত মতো চলার নাম বস্তুবাদী সভ্যতা।
ঈমান ও ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে এমন সভ্যতার লোকেরা যদি সুস্থ বিবেক-বিবেচনা, মধ্যপন্থা ও পরিমিতি, সত্য ও সততা, ন্যায় ও ইনসাফের জীবন যাপন থেকে, প্রকৃত শান্তি ও সুখ থেকে এবং পারিবারিক ও জাতিগত মহব্বত থেকে মাহরুম ও বঞ্চিত থাকে, তা হলে এটা বড় ধরনের কোনো আশ্চর্যের কিছু নয়!
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.