যুলকারনাইনের পরিচয় নির্ণয়ে মুফাসসিরগণ একাধিক মত পেশ করেছেন। প্রসিদ্ধ মত হল, তিনি ছিলেন সিকান্দার মাকদুনি। ইমাম রাযি রহ. এবং অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের অভিমতও এটি। কিন্তু বাস্তবে এ অভিমতটি কবুল করার মতো কোনো শক্তিশালী দলিল-প্রমাণ এবং অন্তর্গত প্রেরণা ও সমর্থন বিদ্যমান নেই।
কারণ, সিকান্দার মাকদুনির মধ্যে ওইসব গুণাবলি মোটেও পাওয়া যায় না, কোরআন মাজিদে যুলকারনাইনের জন্য যেগুলোর উল্লেখ ও আলোচনা করা হয়েছে। যেমন: যুলকারনাইন ছিলেন ঈমানদার-মুমিন; আল্লাহকে ভয় করা মুত্তাকি; আদল ও সাম্য, ন্যায় ও ইনসাফের অধিকারী; বিজিত এলাকাবাসীর সঙ্গে রহম ও দয়ার আচরণকারী; বিশাল ও অসাধারণ লৌহপ্রাচীর নির্মাণকারী। যুলকারনাইনকে সিকান্দার মাকদুনি মনে করার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী হল, সিকান্দার মাকদুনির ইতিহাস, তার যুদ্ধের হাল-হাকিকত সম্পর্কে সঠিক অবহিতি ও অবগতি না থাকা। গভীর ও নিবিড়ভাবে ইতিহাস মুতালাআ না করা। কঠিনভাবে ইতিহাসকে বিচার-বিশ্লেষণ না করা। ফলে যুলকারনাইনকে সিকান্দার মাকদুনি মনে করার মতো ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে এবং এটা প্রচার-প্রসারও পেয়েছে।
কিছু আধুনিক গবেষক ও আলেমের’ অভিমত হল, তিনি ওই ব্যক্তি যাকে গ্রিকরা সাইরাস বলে; এবং ইহুদিরা খাওরাস বলে। আর আরব ঐতিহাসিকরা কাইখাসরাদ বলেন। কিন্তু আমাদের মতে যুলকারনাইন সম্পর্কে সবচেয়ে সঠিক অভিমতটি ব্যক্ত করেছেন সাইয়েদ কুতুব শহিদ রহ.। তাঁর অভিমতটি এখানে তুলে ধরা মোনাসেব ও উপযোগী মনে করছি। তিনি তাঁর তাফসির ফি যিলালিল কোরআন-এ লিখেছেন: ‘কোরআন মাজিদে যুলকারনাইনের যে বর্ণনা এসেছে, তাতে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়, তাঁর আগমন কাল ও স্থান সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। আসলে কোরআনে বর্ণিত ঘটনাগুলোর মধ্যে এ দিক ও বিষয়গুলোকে পরিত্যাগ করা হয়েছে। কবে কোন ঘটনা ঘটেছে, সেইসব তারিখ জানানো কোরআনে কারিমের উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ওইসব শিক্ষা, যা এসব ঘটনা থেকে পাওয়া যায়। মানব জীবন ও তার সুখ-শান্তির প্রয়োজন যে শিক্ষা, তা চিরদিনের জন্যই এক। এ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য যেসব ঘটনা বর্ণনা করা হয়, তাও সব যামানার জন্য একইভাবে প্রযোজ্য বিধায়, ওইসব ঘটনাকে অধিকাংশ স্থানে কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা কালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয় নি। এ জন্যেই কোরআন মাজিদে যুলকারনাইনের ঘটনাসমূহের স্থান ও কালের কথা উল্লেখ নেই।
প্রচলিত ইতিহাসে সিকান্দার যুলকারনাইন নামক যে বাদশা সম্পর্কে জানা যায়, সেই ব্যক্তি ও কোরআন মাজিদের বর্ণিত যুলকারনাইন এক ব্যক্তি নয়। কারণ, প্রচলিত সিকান্দার ছিল মূর্তিপূজক গ্রিক রাজা। আর কোরআন মাজিদ বর্ণিত যুলকারনাইন ছিলেন এক ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী। পুনরুত্থান ও আখেরাতের জীবনের ওপর ছিল তার প্রগাঢ় বিশ্বাস।
জ্যোতির্বিদ আবু রায়হান আল-বিরুনি রহ. লিখেছেন: ‘কোরআন শরিফে বর্ণিত যুলকারনাইন ছিলেন হিমইয়ারের )حمي( অধিবাসী। তার নাম থেকেই তিনি এ কথা প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। কারণ, হিমইয়ারের বাদশারা তাদের উপাধির মধ্যে ‘যু’ (৩১) শব্দটি অবশ্যই ব্যবহার করতেন। যেমন: যু-নুয়াস, যু-নাইরান।

যে যুলকারনাইনের কথা এখানে এসেছে, তার মূল নাম ছিল আবু বকর ইবনে আফরিকাশ। তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে ভূমধ্য সাগরের উপকূলে পৌছে যান। সেখান থেকে তিনি তিউনিসিয়া, মরক্কো ইত্যাদি দেশের দিকে অগ্রসর হন। তিনি আফ্রিকা মহাদেশে একটি নগরী নির্মাণ করেন। এ নামেই সেখানকার সকল এলাকার নামকরণ করা হয়। তাকে যুলকারনাইনের নামে অভিহিত করা হতো। যেহেতু তিনি সূর্যের উভয় প্রান্তে (পূর্ব-পশ্চিম) ভ্রমণ করেছিলেন।’
আল-বিরুনির এ অভিমত সঠিক হলেও হতে পারে। কিন্তু এ কথা প্রমাণ করার মতো আমাদের কাছে যথেষ্ট যুক্তি বা উপায়-উপাদান নেই। কোরআনে কারিমে ফুলকারনাইনের জীবনী সম্পর্কে যে আংশিক বর্ণনা এসেছে, প্রচলিত ইতিহাস থেকে আমরা এর বেশি কোনো তথ্য পাই না। কোরআন মাজিদে অন্য যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোর মতোই তার সম্পর্কে সামান্য কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় মাত্র। যেমন দেখা যায় কওমে নূহ, কওমে হুদ ও কওমে সালেহ ইত্যাদি জাতি সম্পর্কে কোরআন মাজিদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে কোরআনের বর্ণিত এবং প্রাচীন যুগের অনেক ঘটনারই কোনো বর্ণনা-বিবরণ নেই। কারণ, লিখিত ও সংরক্ষিত ইতিহাসের চেয়ে মানব জাতির বয়স অনেক বেশি। লিখিত ও সুবিন্যস্ত ইতিহাসের আগে বহু ঘটনা অতিবাহিত হয়ে গেছে, যার খবর ইতিহাস ও ঐতিহাসিকদেরও নেই। আর যেসব ইতিহাসগ্রন্থ আমরা দেখতে পাই, এগুলোর বেশিরভাগই অনুমান করে রচনা করা হয়েছে। ফলে প্রাক-ইতিহাস যুগের বহু ঘটনা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। সুতরাং ওইসব ঘটনা ও বিষয় সম্পর্কে ইতিহাসগ্রন্থকে জিজ্ঞেস করা একেবারেই নিরর্থক। এজন্য প্রাক-ইতিহাস সম্পর্কে ইতিহাসগ্রন্থের বর্ণনা-বিবরণই একদম গ্রহণযোগ্য- এমনটা মোটেও না।
ইহুদিরা যদি তাওরাতকে মিশ্রিত ও বিকৃত না করত, এটি যে অবস্থায় নাযিল হয়েছিল সে অবস্থায় আজ পর্যন্ত বর্তমান থাকত, তা হলে সেটি থেকে অতীতের রাজা-বাদশা ও জাতিসমূহ সম্পর্কে বহু প্রামাণ্য ও সত্য-সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হতো। নিঃসন্দেহে এ কথা সত্য, বর্তমান তাওরাত বহু কাল্পনিক কাহিনিতে ভরপুর হয়ে আছে। এতে এমনও অনেক বর্ণনা আছে, যা আল্লাহর প্রেরিত মূল ঘটনার ওপর যথেষ্ট রং চড়িয়ে লেখা হয়েছে। খৃস্টানদের ইনজিল কিতাবেরও একই অবস্থা। ফলে কোরআন মাজিদ ছাড়া অন্য কোনো আসমানি কিতাবকে প্রামাণ্য বা ঐতিহাসিক তথ্যাবলির সঠিক উৎস বলে আর মনে করা যায় না যেটি বিকৃতি ও বিবর্তনের সব ধরনের প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। কোরআন নিজেই ওইসব ঐতিহাসিক ঘটনার একক সূত্র ও উৎস-মূল, যেগুলো তার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। আর এ কথা তো অত্যন্ত স্পষ্ট, ইতিহাসের সত্যাসত্যির নিরীখে কোরআন মাজিদের কোনো বিষয় বা ঘটনার পর্যালোচনা হতে পারে না। এর কারণ দুটি।
এক. ইতিহাসের জন্ম হয়েছে অতি সাম্প্রতিককালে; অথচ ইতোপূর্বে সংঘটিত মানব ইতিহাসের অসংখ্য ঘটনা অজানার অন্তরালে রয়ে গেছে, যে বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। এ অবস্থায় কোরআন মাজিদ ওইসব হারানো দিনের অনেক তথ্য পেশ করেছে, যার কোনো খবরই ইতিহাস রাখে না।
দুই, অতীতের ঘটনাবলির মধ্য থেকে কোনো কিছু যদি ইতিহাসে পাওয়া যায়ও, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তি নেই। কারণ সেগুলো হচ্ছে সংকীর্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন ও অপ্রতুল জ্ঞানের অধিকারী মানুষের তৈরি। এবং সেসব গ্রন্থ পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও অতিরঞ্জনের দোষ-ত্রুটি ও বিচ্যুতি থেকে মোটেও মুক্ত নয়। এর নজির তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। সময়টা এখন এমন, অজানা ও গোপন তথ্যাদির সত্যাসত্যি জানা বা যাচাই করা অতি সহজ। অথচ সংবাদমাধ্যমগুলো একটা সংবাদ বা তথ্যকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। মতলববাজির নানা অর্থ ও রং তাতে চড়ায়। এবং এসব সম্পর্কে যে বিভিন্নমুখী বিবরণ দেওয়া হয়, দেখা যায় তার কোনোটা কোনোটার বিপরীত। সংবাদমাধ্যম থেকেই তো গ্রহণ করা হয় ইতিহাসের উপাদানসমূহ এবং এভাবেই গড়ে উঠেছে আধুনিক ইতিহাসের ধারা। এটাই ইতিহাস সম্পর্কে আসল সত্য-এ ব্যাপারে যে যত বাগাড়ম্বরই করুক না কেন।
এখন সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, কোরআনে কারিমে যেসব ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোকে যদি ইতিহাসের মাপকাঠিতে বিচার করা হয়, তা হলে যে কথাটি সামনে আসে তা হচ্ছে, কোরআনে কারিমের দেওয়া তথ্য ও সংবাদকে অস্বীকার করে মানুষের উদ্ভাবিত সেসব নীতি ও নিয়ম কার্যকর করতে হবে, যা সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট-চিত্তে মেনে নিতে পারে। এ কথা বলার সময় অবিশ্বাসী প্রগতিবাদীরা খেয়াল করে না, চূড়ান্ত ফয়সালা-দানকারী কোরআন মাজিদের সঙ্গে মানুষের বানানো নিয়ম-নীতি সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে কি না! কোনো মুমিনই কোরআনের বর্ণিত তথ্য ও সংবাদ ছেড়ে সব সময় পরিবর্তনশীল বিজ্ঞানের উদ্ভাবিত তথ্য মেনে নিতে পারে না। কারণ, মানুষের আবিষ্কৃত সব তথ্যাদির ভিত্তিই হচ্ছে অনুমান। আর অনুমান কখনো সঠিক হয়, কখনো বেঠিক হয়।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে কিছু সংখ্যক লোক যুলকারনাইন সম্পর্কে জানতে চাইল। যেহেতু তারা আল্লাহর রাসূলকে পরীক্ষা করার জন্য এ প্রশ্ন করেছিল, এজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ওহির মাধ্যমে তাঁকে এ বিষয়ে জানিয়ে দিলেন। আলোচ্য আয়াতে আমরা সেই বিবরণটিই পাচ্ছি।
যুলকারনাইন সম্পর্কে জানার সব থেকে নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে কোরআন মাজিদ। আর এখানে যে বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, তার জবাব একমাত্র কোরআন মাজিদ ছাড়া অন্য কোনো সূত্র থেকে পাওয়ার কোনো উপায় নেই। এ বিষয়ে আমাদের কোনো জ্ঞান না থাকায়, যতটুকু কোরআনে উল্লেখ হয়েছে তার বেশি কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার সাধ্য আমাদের নেই।
এ সম্পর্কে বিভিন্ন তাফসিরে বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু এসবের কোনোটিকেই নিশ্চিতভাবে গ্রহণ করা যায় না। এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে চাইলে খুবই সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। কারণ, ইহুদিদের বিকৃত-বর্ণনাও তাতে মিশ্রিত আছে।’ (সাইয়েদ কুতুব শহিদ রহ., তাফসির ফি যিলালিল কোরআন: ১২/৩২৭)

আচ্ছা যা-ই হোক, আমরা নির্দিষ্টভাবে এ রকম কোনো ব্যক্তি পাই বা না পাই, যাকে যুলকারনাইন বলতে পারি এবং তার ওপর ওইসব বিস্তারিত পর্যালোচনা উপযোগী করতে পারি, যা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং অপর্ণাঙ্গ ও মতভেদপূর্ণ ইতিহাস আমাদের পথনির্দেশ করুক বা না করুক, যা অনেক পরে সংরক্ষণ ও বিন্যাস শুরু করা হয়েছে এবং যা থেকে নিশ্চিত ও অকাট্যভাবে কোনো রায় ও মতামত পেশ করা অনেক কঠিন; এতে কোরআন মাজিদ অধ্যয়নকারীর কোনো নুকসান-ক্ষতি নেই।
কারণ, যুলকারনাইনের জরুরি সব আওসাফ ও গুণাবলি কোরআন মাজিদের মাধ্যমে আমাদের সামনে এসে গেছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, দূরদর্শিতা, দুঃসাহসিকতা, প্রাজ্ঞতা ও সামর্থ্য দান করেছেন; এবং উৎপাদন ও উদ্ভাবনের সব ধরনের সামগ্রী ও সামর্থ্য দান করেছেন। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَأَتَيْنَاهُ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ سَبَبًا، فَأَتْبَعَ سَبَبًا.
অর্থ: আর আমি তাকে সব ধরনের উপায়-উপকরণ সহজ ও অনায়াস করে দিয়েছি। ফলে সে একটি (গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের) অনুগামী হল। (সূরা কাহাফ: ৮৪-৮৫)
যুলকারনাইনের দেশ বিজয়ের পরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত। তিনি অভিযান পরিচালনা করেছেন পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের শেষ সীমা পর্যন্ত; যেটি কোরআন মাজিদে )مطلع الشر ( সূর্য উদয়স্থল এবং ) مغرب সূর্য অস্তাচল বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনি এসব দেশ বিজয়ের সময় ছিলেন মানবতার একজন কল্যাণকামী। তার সব কর্মপদ্ধতিতে ছিল মানুষ ও মানবতার জন্য সংস্কার ও সংশোধন। তিনি ছিলেন সত্যের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক। দুর্বলদের তত্ত্বাবধায়ক। অনাচারী অবাধ্য যালেমদের জন্য ছিলেন কষাঘাতকারী জ্বলন্ত চাবুক। এটিই ছিল তাঁর উসুল ও নীতি।
পবিত্র কোরআন তাঁর ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছে:
قَالَ أَمَّا مَنْ فَلَمَ فَسَوْفَ نُعَذِّبُهُ ثُمَّ يُرَدُّ إِلَى رَبِّهِ فَيُعَذِّبُهُ عَذَابًا نُكُرًا، وَأَمَّا مَنْ أَمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُ جَزَاء الْحُسْنَى وَسَنَقُولُ لَهُ مِنْ أَمْرِنَا يُسْرًا.
অর্থ: যুলকারনাইন বলল, যে ব্যক্তি যুলুম করবে অচিরেই তাকে আমি ভয়ানক শান্তি দেব। তারপর (এ জীবন শেষে যখন) তাকে তার প্রতিপালকের কাছে পৌঁছানো হবে, তখন সেখানেও তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দেবেন। তবে যে ঈমান আনবে ও নেককাজ করবে, সে উত্তম প্রতিদান ও পুরস্কার পাবে। এবং আমিও আদেশ দানকালে তাকে সহজ কথা বলব। -(সূরা কাহাফ: ৮৭-৮৮)
অর্থাৎ, যুলকারনাইন লোকদের বলেছেন, আমি তোমাদের সরল পথে চলার দাওয়াত দেব। যারা এ দাওয়াত কবুল করবে না, বরং যুলুমের পথ অবলম্বন করবে আমি তাদের শান্তি দেব। আর যারা দাওয়াত কবুল করে ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে, তাদের প্রতি আমি সহজ ও সদয় আচরণ করব।
যুলকারনাইনের এ উসুল ও নীতির মধ্যে যে পবিত্রতা ও সততা এবং এ কর্মসূচি ও অভিযানের মধ্যে যে পূর্ণতা ও সাম্যতা রয়েছে, সেটি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। তাঁর এ আচরণ ও উচ্চারণের মধ্যে যে বুলন্দ আখলাক ও হুসনে সিরাত রয়েছে, সেটিও বিশ্লেষণের কোনো জরুরত নেই। যুলকারনাইন দেশ বিজয়কালে এমন এক জনবসতির পাশ দিয়েও অতিক্রম করেছেন, যেটি ছিল পাহাড়ি এলাকায়। তারা সব সময় মুসিবতের শিকার হতো এবং বিপদের ভয়ে শঙ্কিত থাকত। একটা বর্বর ও নিষ্ঠুর জাতি তাদের ওপর প্রায়ই হামলা করত। যারা পাহাড়ের ওপর পাশে থাকত। কোরআন মাজিদ ও অন্যান্য আসমানি কিতাবে এই বর্বর জাতিকে ইয়াজুজ-মাজুজ বলা হয়েছে।১
এ পাহাড়ি জনবসতি প্রায়ই ইয়াজুজ-মাজুজের অনাচার ও হামলার শিকার হচ্ছিল। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে বলেন:
وَتَرَكْنَا بَعْضَهُمْ يَوْمَئِذٍ يَمُوجُ فِي بَعْضٍ.
অর্থ: সেদিন আমি তাদের অবস্থা এমন করে দেব, তারা তরঙ্গের মতো একে অন্যের ওপর আছড়ে পড়বে। (সূরা কাহাফ: ৯৯)
কেয়ামতের কাছাকাছি সময়ে ইয়াজুজ-মাজুজ যখন পাহাড়ের ওপর প্রান্ত থেকে বের হয়ে আসবে, তখন তাদের অবস্থা হবে বিশৃঙ্খল ভেড়ার পালের মতো এবং তারা ঢেউয়ের মতো একে অন্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
পাহাড়ি জনবসতির লোকেরা যুলকারনাইনকে দেখে বুঝতে পারল, এটি একটি মূল্যবান সুযোগ। আল্লাহ তায়ালা একজন শক্তিমান নেককার বাদশাকে তাদের কাছে পাঠিয়েছেন। তারা যুলকারনাইনের কাছে আবেদন করল, তিনি যেন তাঁর হাতে থাকা বিপুল উপকরণ এবং বিশাল সৈন্যবাহিনী দ্বারা তাদের জন্য একটা ব্যবস্থা করে দেন। যাতে তারা বর্বর ইয়াজুজ-মাজুজের অনাচার থেকে বাঁচতে পারে। সেইসঙ্গে এ প্রস্তাবও পেশ করল, তারা এ কাজের জন্য কিছু অর্থ যোগান দেবে।
নেককার ও জনকল্যাণকামী বাদশা যুলকারনাইন তাদের আবেদন কবুল করলেন, তিনি তাদের জন্য একটি সুরক্ষিত দেয়াল তৈরি করে দেবেন। কিন্তু দুনিয়াদার ক্ষমতা লোভী ও জনকল্যাণে ব্যয়কুন্ঠ কৃপণ শাসকদের বিপরীত তাদের আর্থিক সহযোগিতার প্রস্তাবটি কবুল করেন নি; বরং আল্লাহ তায়ালা তাকে যা কিছু দিয়েছিলেন, তা থেকে খরচ করেছেন। তিনি তাদের বললেন, টাকা-পয়সা লাগবে না। তোমরা শ্রম দিয়ে এবং গলিত ইস্পাতের যোগান দিয়ে সহযোগিতা করো। পবিত্র কোরআনের ভাষায়:
قَالَ مَا مَكَلِي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا، أَتُونِي زُبَرَ الحديد.
অর্থ: যুলকারনাইন বলল, আমার রব আমাকে যা দিয়েছেন, তা-ই আমার জন্য উত্তম। (তোমাদের টাকা-পয়সা দেওয়া লাগবে না।) তোমরা বরং শ্রম দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করো। আমি তোমাদের ও ইয়াজুজ-মাজুজের মাঝে একটি মজবুত প্রাচীর গড়ে দেব। তোমরা আমাকে লোহার পিণ্ড এনে দাও। -(সূরা কাহাফ: ৯৫-৯৬)
কওমের সবাই প্রাচীর নির্মাণের কাজে শরিক থাকল। তাদের সবার আগে থাকলেন যুলকারনাইনের মতো নেককার ও কর্মকুশলী বাদশা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা প্রাচীর নির্মাণের বিষয়টি বর্ণনা দিয়েছেন:
حَتَّى إِذَا سَاوَى بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ انْفُخُوا حَتَّى إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ أَتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ قطرا
অর্থ: এরপর লোকেরা উভয় পাহাড়ের (মাঝখানের ফাঁকা পূর্ণ করে) চূড়া পর্যন্ত লোহার পিণ্ড দিয়ে বরাবর করে দিল। তখন যুলকারনাইন বলল, এবার আগুনে হাওয়া দাও। যখন লোহাগুলো আগুনের মতো লাল হয়ে গেল, তখন সে বলল, তোমরা গলিত তামা নিয়ে এসো। আমি তা এর ওপর ঢেলে দেব। (সূরা কাহাফ ৯৬)
যুলকারনাইন প্রথমে লোহার বড় বড় পিও ফেলে দুই পাহাড়ের মাঝখানটা ভরে ফেললেন। লোহার সে স্তূপ পাহাড় সমান উঁচু হয়ে গেল। তার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। যখন তা পুরোপুরি উত্তপ্ত হল তখন এর ওপর গলিত তামা ঢেলে দিলেন। যাতে তা লৌহপিণ্ডের ফাঁকে-ফাঁকে গিয়ে সব ফাঁক-ফোকর ভরাট করে ফেলে।
এভাবে এটি একটি মজবুত দেয়াল হয়ে গেল। নির্মিত হল একটি সুরক্ষিত প্রাচীর। এর ফলে সেই পাহাড়ি জনবসতি বর্বর ইয়াজুজ-মাজুজের হামলা থেকে নিরাপদ হয়ে গেল। এর পর থেকেই ইয়াজুজ-মাজুজও প্রাচীর ডিঙিয়ে এ পাশে আর আসতে পারে না। আল্লাহ বলেন:
فَمَا اسْطَاعُوا أَنْ يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ نَقْبًا.
অর্থ: (এভাবে প্রাচীরটি নির্মিত হয়ে গেল।) ফলে ইয়াজুজ-মাজুজ না তার ওপর চড়তে পারছিল, না সেটিকে ফুটো ও ফাটল ধরাতে পারছিল। -(সূরা কাহাফ: ৯৭)

মুমিনের দূরদর্শিতা এবং দীনি উপলব্ধি
যখন এ অসাধারণ প্রাচীরটির নির্মাণ কাজ শেষ হল, তখন যুলকারনাইন পরম সত্যের প্রতি লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তিনি অন্য সব রাজা-বাদশাদের মতোই ছিলেন। বিভিন্ন দেশ ও জাতির ওপর বিজয় লাভকারী ছিলেন। সমগ্র দুনিয়া শাসনকারী ছিলেন। কিন্তু সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন একজন ঈমানদার। মুমিন বাদশা। ফলে এত বড় কাজ করার পরও তাঁর মধ্যে তাকাব্বুর ও দাম্ভিকতা পয়দা হয় নি। তাঁর ভেতর অহঙ্কার ও অহমিকা দানা বাঁধে নি। গাফলত ও উদাসীনতা তাঁকে ছেয়ে রাখতে পারে নি। তিনি বলেন নিঃ
إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِندِي.
অর্থ: এ সবকিছু তো আমি আমার জ্ঞানের কারণে প্রাপ্ত হয়েছি। -(সূরা কাসাস: ৭৮)
বরং যুলকারনাইন বলেছেন, তাঁর সব প্রাপ্তি ও অর্জন মহান আল্লাহর দান। তাঁর সবকিছুর মালিক আল্লাহ তায়ালাই। এমনকি যুলকারনাইন অপছন্দনীয় দাগযুক্ত এই কথাটাও বলেন নি: তাঁর এ ঐতিহাসিক কাজ ধ্বংসের উর্ধ্বে। এ প্রাচীর কখনো দাংস হবে না। এটাকে কখনো ছিদ্র ও সুড়ঙ্গ করা যাবে না।
ফুলকারনাইন একজন দূরদর্শী ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মুমিন ছিলেন।
বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ছিলেন। হৃদয়-আত্মা আলোকিত একজন ঈমানদার ছিলেন। আখেরাতের প্রতি দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন। ইনসানি কমজোরি ও মানবিক দুর্বলতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন। মানুষের সামর্থ্য, জ্ঞানের স্বল্পতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাই প্রাচীর নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পর যুলকারনাইন সামান্য দুটি কথা বলেছেন, যা বাস্তব ও চিরসত্য। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কথাটিকে পছন্দ করেছেন। তিনি কোরআন মাজিদে তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন।
قالَ هَذا رَحْمَةٌ مِن رَبِّي فَإِذَا جَاء وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاءَ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا
অর্থ: যুলকারনাইন দেয়ালের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর বলল, এটি আমার রবের মেহেরবানি (তিনি আমাকে এ রকম একটি প্রাচীর বানানোর তাওফিক দিয়েছেন।)। এর পর আমার রবের প্রতিশ্রুত সময় যখন আসবে, তখন তিনি প্রাচীরটিকে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবেন (কিন্তু এর আগে কেউ এটিকে ভাঙতে পারবে না।)। আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত সত্য। (সূরা কাথাফ। ৯৮)
অসাধারণ ও ঐতিহাসিক এ প্রাচীরটি এমন একজন মহাত্মা ও মহিমাময় সচেতন মানুষের কীর্তি, যিনি বাহ্যিক সব উপায়-উপকরণকে নিজের অধীন করে নিতে সক্ষম ছিলেন। যাবতীয় কর্ম-ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির লাগাম তাঁর হাতে ছিল। তাঁর বিজয় অভিযান এবং কীর্তিময় অবদানের পরিধি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল; কিন্তু তিনি বস্তুবাদী শক্তি ও সক্ষমতার চূড়ায় অবস্থান করার পরও তাঁর রবের ব্যাপারে গাফেল হয়ে যান নি। বাদশাহির শীর্ষ সীমায় আরোহণ করেও মহান আল্লাহকে ভুলে যান নি।
বরং যুলকারনাইনের গরদান হামেশা আল্লাহ তায়ালার হুকুমের সামনে অবনত ছিল। আখেরাত ছিল তাঁর লক্ষ্য ও কাঙ্ক্ষিত মনযিল। তিনি সেটি অর্জনের জন্য সব সময় উদামী ও পরিশ্রমী এবং ভীত ও কম্পিত ছিলেন। নিজের দুর্বলতা ও শক্তি-সামর্থ্যহীনতার কথা স্বীকারকারী ছিলেন। তিনি দুর্বলদের সঙ্গে রহম ও দয়ার আচরণ করতেন। হক ও দীনের হেমায়েত করতেন। সত্য ও ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। যুলকারনাইন নিজের সকল সামর্থ্য মানুষের খেদমতে এবং মানবতার কল্যাণে ব্যয় করতেন। সুন্দর সমাজ ও পরিবেশ নির্মাণে সচেষ্ট থাকতেন। আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার ফিকির করতেন। মানুষকে গোমরাহির অন্ধকার থেকে হেদায়েতের আলোতে আনার চেষ্টা করতেন। বস্তুবাদের পূজা থেকে মুক্ত করে আল্লাহর বন্দিগির দিকে তাদের রাহনুমায়ি করতেন। এটি এমন এক আদর্শ, যা হযরত সুলাইমান বিন দাউদ আ. তাঁর যুগে, হযরত যুলকারনাইন তাঁর সময়ে, খোলাফায়ে রাশেদিন তাদের যামানায় এবং মুসলিম শাসকগণ আপন আপন যুগে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে স্থাপন করে গেছেন।
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.